উপন্যাস: স্বপ্নীল হাসি
উপন্যাসিক: মোঃ নূরুল আলম আবির
প্রকাশ: বইমেলা, ২০১০ইং(পর্ব—৫)
মা, তুমি বিষয়টা বুঝতে পেরেছ। তুমি তো বুঝবেই। কারণ তুমি একজন শিক্ষিত নারী।
সজল, হাসির বিয়ের আর মাত্র কয়েকদিন বাকী। এ মাসের ২৫ তারিখ বিয়ের দিন ধার্য্য করা হয়েছে।
শুনেছি যৌতুকও দিচ্ছে।
হ্যাঁ, তা তো দিচ্ছেই। গ্রামের মেয়েদের যৌতুক ছাড়া বিয়ে হয় নাকি? মাঝ মাঠের ২০ শতক জমিন বিক্রি করে গফুর ভাই বর পক্ষকে ৫০ হাজার টাকা দেয়ার কথা। বাকী টাকা বিয়েতে খরচ করবে।
জমি কি বিক্রি করে ফেলেছে?
শুনেছি এখনো পারেনি। দর কষাকষি চলছে।
কার সাথে?
খান বাড়ির আবদুর রশিদের সাথে।
আমি আবদুর রশিদকে কিছুতেই জমি কিনতে দেব না। দেখি গফুর চাচা কেমন করে জমি বিক্রি করে আর যৌতুক দিয়ে কিভাবে মেয়ের বিয়ে দেয়?
তুই এখন পড় বাবা। ওর কথা ভেবে ভেবে নিজের জীবনের কথা ভুলে যাসনে।
থ্যাঙ্ক ইউ মা। আমি পড়ছি। তুমি এখন যাও।
মা আমার কপালে চুমো খেয়ে চলে গেল।
আমি রাত ১১টা পর্যন্ত পড়ে শুয়ে পড়লাম। রাত প্রায় ১২টার সময় হাসি আমাকে জানালা দিয়ে ডাকতে এলো। জানালার কাছে এসে ফিসফিস করে ডাকতে লাগল বিরামহীন।
জানালা খুলে দেখি হাসি।
কীরে হাসি তুই?
জি আমি।
এত রাতে! ঘুমাসনি?
আমার ঘুম আসছে না। আসুন না ভাইয়া। আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।
আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলাম না। উঠে পড়লাম। আস্তে করে দরজা খুলে চুপিচুপ বের হলাম।
কি বলবি বল।
এখানে নয়।
কোথায়?
পুকুর পাড়ে চলেন।
এত রাতে পুকুর পাড়ে কেন?
চলেন না ভাইয়া, বলছি তো!
সে আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল পুকুর পাড়ে। সেই কদমতলায়। এখানে বিকেলের সূর্যের পরিবর্তে এখন চাঁদ উঠেছে। মনে হচ্ছে যেন সূর্যকে বিদায় জানিয়ে চাঁদ এসেছে বিজয়ের হাসি হেসে। আমাদের দু’জনকে অতন্দ্র প্রহরীর মত চাঁদ আর তারারা পাহারা দিচ্ছে। ঘনবনে জোনাকীরা জ্বলে জ্বলে নিভে যাচ্ছে। কানে আসছে ঝিঁঝি পোকার ডাক। হালকা বাতাস এসে আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে নীরবে।
হাসি নিজের গায়ের ওড়নাটা দু’ভাজ করে মাটিতে বিছিয়ে দিল। সে আগে বসল। তারপর আমাকে হাত ধরে টেনে তার পাশে বসিয়ে বলল—
আজ আপনাকে অনেক কথা বলব।
ঠিক আছে বল। তোর জীবনের সব কথাই বলতে পারিস। সে চুপ হয়ে থাকলো। কেমন যেন লাজুক লাজুক ভাব।
কিরে হাসি তুই না আমাকে অনেক কথা বলবি?
বলব তো।
বল তাহলে।
সে আলতো শব্দ করে হাসছে। গাছের ফাঁক দিয়ে জোছনার বিন্দু বিন্দু আলো তার চেহারায় এসে পড়েছে। সে আলোয় তার মায়াবী হাসি দেখতে পাচ্ছি। রূপালী চাঁদের আলোয় ওর হাসি দেখে আমি তাকে পরী ভেবে বসলাম। পরীরা অনেক সুন্দর হয় জানি। আজ হাসিকে পরীর চেয়েও সুন্দর লাগছে। ওর কথা আর হাসি বড়ই স্বপ্নীল ও মায়াবী সুন্দর। কতইনা নিপুনভাবে সে হাসে আর কথা বলে! সে সাদা পোশাক পরলে, তাকে নিশ্চিত পরীর মত লাগতো। ওর সফেদ চেহারা থেকে আলো ঠিকরিয়ে বের হচ্ছে যেন। ঝলমলে মায়াবী আলোকময় হাসির অপরূপ মুখচ্ছবি।
তুই এখনো চুপ কেন, হাসি? তুই যেহেতু কিছু বলবি না, আমি আর কি করব তোর কোলে ঘুমাই। আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। তুই বসে বসে আমাকে পাহারা দে।
আমি ঘুমিয়ে পড়লাম হাসির কোলে মাথা রেখে। হাসি তখনো নীরব, কিছুই বলছে না। সে আমার চুলগুলো দু’হাত দিয়ে নাড়ছে। মাঝে মাঝে আমার মুখ ও বুকের উপর হাত দিয়ে পরশ দিচ্ছে। আমার মনে হতে লাগল, সে নিশ্চয়ই কিছু একটা ভাবছে।
কিরে হাসি, তুই যে কিছুই বলছিস না। শুধু শুধু আমার ঘুম ভেঙে দিলি।
বলছি ভাইয়া। কিন্তু আমি যে লজ্জায় কিছুই বলতে পারছি না।
কিসের লজ্জা? এত রাতে আমার সাথে পুকুর পাড়ে বসে আছিস, লজ্জা নেই। কি কথা বলবি, সেখানে তোর লজ্জা লাগছে।
আমি গতকাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। সেই স্বপ্নটা বলার জন্যই আপনাকে ডেকেছি। কিন্তু আমি লজ্জায় বলতে পারছি না।
না বললে আমি চলে যাচ্ছি।
বলছি ভাইয়া। আমি গতকাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আমি কাঁদছি। কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখ ফুলে গিয়েছিল। কারণ সে বিয়েতে আমার সম্মতি ছিল না। বাবা-মা জোর করে আমার বিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু পরে আমি দেখি, যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, সে আমার বর হয়ে আসেনি। এসেছেন আপনি!
হাসির স্বপ্নের কথা শুনে আমি তো হতবাক! তার স্বপ্নের মহানায়ক যে আমি হবো, তা আমার কল্পনারও বাইরে। কারণ আমি এভাবে হাসিকে কখনো ভাবিনি।
আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। তারপর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুই কি আমাকে ভালোবাসিস? সত্যি করে বল।
হ্যাঁ ভালোবাসি। আমি আপনাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসি।
কোনোদিন তো বললি না। কখনো বুঝতেও পারিনি। তুই আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসে থাকলে, তোর ভালোবাসাকে অবহেলা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ভাবলাম, মেয়েটার এমনিতেই বিপদ। তাকে জোর কে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। সে চিন্তায় তার ঘুম নেই, খাওয়া নেই। এর উপর আমার প্রতি তার ভালোবাসার আবেদন খারিজ করে দিলে, সে আবার কি থেকে কি ঘটায় কে জানে? তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, তাকে ভালোবাসবো। তার হীরাখচিত মূল্যবান ভালোবাসাটা গ্রহণ করবো সোল্লাসে। এছাড়া আমার যে আর কোনো উপায় নেই!
আমি হাসির চোখেচোখে তাকালাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে আলতো করে হেসে দিল। তার হাসির মোহনীয়তায় আমার হৃদয় ভরে উঠল। তার চোখেমুখে কাছে টানার চৌম্বক আকর্ষণ আমি এড়াতে পারলাম না। আমি হেরে গেলাম তার কচিকোমল ভালোবাসার কাছে, হেরে গেলাম তার অপরূপ সৌন্দর্যের রূপের গভীরতায়। চাঁদের রূপালী জোছনার আলোয় তার হাসি এত রূপময় দেখালো যে, আমি তা কিছুতেই বলে বুঝাতে পারব না। হাসতে ব্যস্ত থাকা হাসির দু’টি লাল ঠোঁট মিলিয়ে যেতে না যেতেই— আমি তার ঠোঁটে আমার ঠোঁটজোড়া মিলিয়ে দিয়ে বড্ড আস্তে করে একটি চুমো খেলাম। এই একটি চুমোই আমাকে বুঝিয়ে দিল— প্রেম কাকে বলে? ভালোবাসার রঙ কত অপরূপ সুন্দর হয়? প্রেমের সাধ কত সুমিষ্ট হয়! প্রিয়জনের পরশ কত অপূর্ব হয়?
তারপর হাসি আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমিও তাকে হৃদয়ের সাথে মিশিয়ে নিলাম। আমি তার মাঝে, সে আমার মাঝে মিশে গেল। মনে হলো যেন, একই আত্মায় আমাদের দু’জনের বাস!
হাসিকে বুকে জড়িয়েই বললাম, আমি তোকে আর কোথাও যেতে দেব না। সবসময় এভাবে জড়িয়ে রাখবো। মনেপ্রাণে মিশে থাকবি তুই।
হাসি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, আমার জীবন আজ ধন্য হলো। আপনার মত মানুষের ভালোবাসার স্বীকৃতি আমার কাছে পৃথিবীর সবকিছুর চেয়েও দামী। এত বড় প্রাপ্তির আনন্দ আমি রাখব কোথায়? এত বড় স্বপ্নজয়ের পর আমার আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমার জীবনঘরের চাবি আজ আপনার হাতে তুলে দিলাম। আমার ক্ষুদ্র জীবনের সবকিছু আপনার কাছে সঁপে দিলাম। আজ থেকে আমি আপনার। আমার সুখ, দুঃখ, হাসিকান্না, আনন্দ-বেদনা সবই আপনার। আমার নিজের বলতে আর কিছু রইল না।
চলবে…