উৎপল মোহন্তঃ বগুড়ার শিবগঞ্জে তিন ফসলি কৃষি জমিকে এক ফসলি বা অনাবাদী দেখিয়ে সেখানে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পপার্ক স্থাপনের প্রাথমিক প্রস্তাবনা হাতে নিয়েছে বিসিক। এর প্রতিবাদে শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলা-জয়পুরহাট আঞ্চলিক মহাসড়কে এক কিলোমিটার জুড়ে কয়েক হাজার মানুষ মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সমাবেশে করেছেন কৃষকরা।
মঙ্গলবার সকাল ১০ টা থেকে দুপুর পর্যন্ত জমি রক্ষা আন্দোলন কমিটির ব্যানারে এ কর্মসূচি পালিত হয়। মানববন্ধকালীন সমাবেশে বক্তব্য রাখেন শিবগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান তোফায়েল আহম্মেদ সাবু, মোকামতলা ইউপি চেয়ারম্যান মোকলেছার রহমান খলিফা, আওয়ামী লীগ নেতা মোকলেছার রহমান মুন্নু, যুবলীগ নেতা শহিদুল ইসলাম, ছাত্রলীগ নেতা রাকিব আকন্দসহ আরও অনেকে।
গত ১ এপ্রিল বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) একটি চিঠি পাঠায় সংস্থার বগুড়া জেলা কার্যালয়ে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, বগুড়ায় কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পপার্ক স্থাপনের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। পরিকল্পনা কমিশন এক সভায় বগুড়ায় শিল্প পার্কের জন্য উল্লিখিত স্থান (সোনাতলায়) বাদ দেয়। এরপর বগুড়ার তিনটি স্থান পরিদর্শন করে। পরিদর্শন শেষে শিবগঞ্জের দুটি ইউনিয়নের উথলি, নারায়নপুর, সন্নাসী ধোন্দাকোলা, চাঁনপুর, খালিমপুর, ছলেমান ও হরিপুর এলাকায় ৫০০ একর জমি অনাবাদী বা এক ফসলি হিসেবে পাওয়ার কথা জানানো হয়। সেখানে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ সহজ হবে বলেও উল্লেখ করা হয়। এই জমি বরাদ্দের সম্মতি প্রদানসহ বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়।
কৃষকরা বলছেন, বিসিক প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ না করে আমাদের এলাকার ৫০০ একর উর্বর তিন ফসলি কৃষি জমিকে অনুর্বর ও এক ফসলি জমি দেখিয়ে জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবনা দিয়েছে। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে কয়েক হাজার মানুষে মহাসড়কে দাড়িয়ে জমি রক্ষার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। যদি বিসিক শিল্প কর্মকর্তাদের দাবি, আন্দোলনের সঙ্গে ৪০ শতাংশ কৃষক জড়িত। এলাকাবাসীর দাবী, শিবগঞ্জের এই সাতগ্রামে অন্তত ১৮ হাজার লোকজন বসবাস করেন। এর মধ্যে ১২ হাজারের বেশি সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্য রয়েছেন। বিসিকের প্রস্তাবিত ৫০০ একর জমির মধ্যে সাধারণ মানুষের বসতিও রয়েছে।
মঙ্গলবার মানববন্ধন চলাকালে কথা হয় ওই এলাকার বাসিন্দা শ্যামাঙ্গা মদনের (৫২) সঙ্গে, তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা মাতাল হয়ে আমাদের তিন ফসলি কৃষি জমিতে এক ফসলি দেখিয়ে পার্ক করার প্রস্তাবনা হাজির করেছেন। এক বিঘা জমিতে আমি কাঁচা মরিচ, হলুদসহ বিভিন্ন সবজির আবার করে সংসার চালাই। এই জমি চলে গেলে আমি কীভাবে সংসার চালাব?’বিসিক প্রস্তাবিত এলাকার মধ্যে ৬ বিঘা জমি রয়েছে ধান্দাকোলার নারায়ন সরকারের। তিনি বলেন, শিবগঞ্জ কৃষির জন্য প্রসিদ্ধ এলাকা। এখানে ফসল ফলানো বাদে পার্ক হবে এটা কেমন কথা। আমার আমি জমি দিবোনা না, প্রয়োজনে প্রাণ দিব।
কৃষিই একমাত্র আয়ের উৎস চানপুরের সাইফুল ইসলামের। বলেন, ‘৫ বিঘা জমি দিয়ে সংসার চলে। এই জমি গেলে আমি নিঃস্ব হব। কৃষিই আমার একমাত্র আয়ের উৎস। আমাদের এখানকার জমিগুলো আসলে জমি নয় যেনো সোনার থালা। এখানে বছরে তিনবার সোনা ফলে। এই জমি অনাবাদী বলার সাহস হলো কীভাবে বিসিকের?’ওই এলাকায় এর মধ্যে জমি রক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহী সানোয়ার শাহীন বলেন, বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা দেশের সবজির অন্যতম এক কারখানা। এই এলাকায় তিন ফসলি কৃষি জমিতে পার্ক নির্মাণ করা কোনাভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। এই কারণে আমরা সরকারের এই প্রাথমিক প্রস্তাবনার বিরোধীতা করছি। আমরা আসলে কৃষি কাজ করেই বাঁচতে চাই।
জমি রক্ষার জন্য গত ৭ এপ্রিল এলাকাবাসীর পক্ষে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আলমগীর কবিরের কাছে একটি লিখিত আবেদন করা হয়। জানতে চাইলে ইউএনও আলমগীর কবির বলেন, এই বিষয়ে অফিসিয়ালি কিছু জানি না। তবে এলাকার লোকজনের মুখে ঘটনা শুনেছি। সরকারি নির্দেশনা আসলে তদন্ত সাপেক্ষে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে যতদূর জানি এটা এখনো চূড়ান্ত কিছু হয়নি।
তিন ফসলি জমিকে এক ফসলি হিসেবে উল্লেখ করা বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়ার বিসিক শিল্প নগরী কর্মকর্তা শাহীনুর রহমান বলেন, ‘আমরা এলাকার লোকজনের কাছ থেকে শুনেই এই তথ্য জেনেছি। এখানে শিল্প পার্ক হলে কৃষকরাই উপকৃত হবেন। কর্মসংস্থান হবে প্রায় এক লাখ মানুষের। ওই এলাকার ৬০ শতাংশ লোক শিল্পপার্ক চান, ৪০ শতাংশ বিরোধীতা করছেন।’