পিরোজপুরে স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন শহীদ ওমর ফারুক। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতে সহযোদ্ধাদের নিয়ে লুকিয়ে মায়ের কাছে আসতেন তিনি। রাতের আঁধারে চুপি চুপি এসে ডাক দিতেন ‘মা’ বলে। রাত হলেই ছেলের জন্য অপেক্ষায় থাকতেন মা কুলসুম বেগম। ফারুক শহীদ হয়েছেন ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু মায়ের অপেক্ষা শেষ হয়নি।
কুলসুম বেগমের চার ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে ওমর ফারুক ছিলেন সবার বড়। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পিরোজপুরের টাউন ক্লাব চত্বরে (বর্তমানে স্বাধীনতা চত্বর নামে পরিচিত) সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন ফারুক। পরে সহযোগীদের নিয়ে শহরের ট্রেজারি ভেঙে অস্ত্র লুট করেন তিনি। প্রস্তুতি শুরু করেন যুদ্ধের।
এসব কারণে পাকিস্তানিদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হন ওমর ফারুক। তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা। ফলে শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে গা ঢাকা দেন ফারুক। গোপনে যুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের। একাত্তরের ২৯ মে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর কুরিয়ানা থেকে ভারতে যাওয়ার জন্য রওয়া হন ফারুক। লঞ্চে করে গোপনে যাওয়ার পথে তার বাবার অফিসের পাকিস্তানি কর্মচারী হানিফ ফারুককে চিনতে পেরে রাজাকার বাহিনীকে খবর দেয়।
রাজাকাররা ফারুককে আটক করে বরিশালে থাকা পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। ৪ জুন বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর তীরে হানাদার বাহিনী ফারুককে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করে। হত্যার পর তার লাশ গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে তারা।শহীদ ফারুকের বাবা মরহুম সৈয়দুর রহমান শরীফ সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হলে ক্ষোভে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ৯ নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছিলেন।
শহীদ ফারুকের বাড়িতে গিয়ে দেখা হয় তার মা কুলসুম বেগমের সঙ্গে। বয়সের ভারে অনেকটা নুয়ে পড়েছেন। ৫-১০ বছর আগে আরেকটু ভালো ছিলেন। এখন একেবারেই নরম হয়ে গেছে তার শরীর। পরিবারের সদস্যরা জানান, ছেলে ফারুক ফিরে আসবেন সেই বিশ্বাস নিয়েই এখনো বেঁচে আছেন কুলসুম বেগম। এখনো পরিবারের সবাইকে তিনি বলেন ‘ফারুক ফিরে আসবে’। কখনো কখনো ‘ফারুক আসছে’ বলে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠেন। বারবার জানতে চান, ফারুক সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এসেছিল কি না কিংবা তাদের সবাই খেতে পেরেছে কি না?
পরিবারের এক সদস্য জানান, এখনো একটু বেশি করে ভাত রান্না করতে বলেন কুলসুম বেগম। যদি ফারুক আসে, যদি সে খেতে চায়! ঘুমোতে যাওয়ার আগে দরজা খোলা রাখতে বলেন, যদি ছেলে ফিরে আসে! কুলসুম বেগমের মেয়ে জেলা মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সালমা রহমান হ্যাপি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার মা আজও অসহায়ের মতো চেয়ে থাকেন পথের দিকে, বিশ্বাস করেন তার সন্তান ফারুক একদিন ফিরে আসবে। আমরা মাকে কখনোই বোঝাতে পারিনি যে ভাইয়া আর কখনো ফিরে আসবেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘পিরোজপুরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন আমার ভাই। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার নামে এখানকার কোনো কিছুর নামকরণ করা হয়নি।’পিরোজপুর জেলা স্টেডিয়াম ও বেকুটিয়া সেতুর নাম শহীদ ওমর ফারুকের নামে করার দাবি জানান সালমা রহমান।