পাহাড়ে ইউপিডিএফ বয়কটের ডাক দেশসেবা দেশসেবা ডেস্ক রিপোর্ট প্রকাশিত: ১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২১, ২০২৫ মোঃ সোহেল ।। পার্বত্য চট্টগ্রাম গত কয়েকদিন ধরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষার্থী অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ উঠেছে, যা পাহাড়ের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। ছাত্র-জনতা ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ ইউপিডিএফ-এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে তাদের বয়কটের দাবি জানিয়েছে। গত ১৬ এপ্রিল ২০২৫, খাগড়াছড়ির গিরিফুল এলাকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের পাঁচজন শিক্ষার্থী এবং একজন টমটম চালককে অপহরণ করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ)-এর সশস্ত্র সদস্যরা এই অপহরণের জন্য দায়ী। অপহৃত শিক্ষার্থীরা হলেন: ১. মৈত্রীময় চাকমা (চারুকলা বিভাগ) ২. দিব্যি চাকমা (নাট্যকলা বিভাগ) ৩. রিশন চাকমা (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ) ৪. লংঙি ম্রো (প্রাণীবিদ্যা বিভাগ) ৫. অলড্রিন ত্রিপুরা (চারুকলা বিভাগ) এই শিক্ষার্থীরা বিজু উৎসব উদযাপন শেষে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি থেকে খাগড়াছড়ি হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরছিলেন। ১৫ এপ্রিল রাতে তারা খাগড়াছড়ির কুকিছড়া এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাত্রিযাপন করেন। পরদিন সকাল ৬ টায় টমটমে করে শহরে ফেরার পথে গিরিফুল এলাকায় ইউপিডিএফ সশস্ত্র গোষ্ঠী তাদের গতিরোধ করে এবং অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। এমনকি নিরিহ টমটম চালককে ছেড়ে দেওয়া হয়নি এবং অপহরণের ৪ দিন অতিবাহিত হলেও এখনো শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেয়নি অপহরণের ঘটনার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। ২০ এপ্রিল ২০২৫, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এসব সমাবেশে ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী এবং সাধারণ মানুষ অংশ নেন। বিক্ষোভকারীরা ইউপিডিএফ-এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, অপহরণ বাণিজ্য এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার তীব্র নিন্দা জানান। তারা ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ডে “ইউপিডিএফ-এর সন্ত্রাস বন্ধ করো”, “শিক্ষার্থীদের নিঃশর্ত মুক্তি দাও” এবং “ইউপিডিএফ বয়কট করো” স্লোগান তুলে ধরেন। রাঙামাটিতে সুজন চাকমা, মেরেন বিকাশ ত্রিপুরা, প্রহ্লাংঅং মারমা ও কবিতা চাকমার নেতৃত্বে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছে শিক্ষার্থীরা। পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এ ঘটনাকে “ন্যক্কারজনক ও অমানবিক” আখ্যায়িত করে শিক্ষার্থীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছে। পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সভাপতি নিপুণ ত্রিপুরা বলেন, “ইউপিডিএফ (প্রসীত) এই অপহরণের জন্য দায়ী। এটি পাহাড়ের শিক্ষাব্যবস্থা ও শান্তির জন্য হুমকি।” ইউপিডিএফ-এর খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা অপহরণে তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “এই ধরনের প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি আমরা করি না। কোনো মহল ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাদের ওপর দায় চাপাচ্ছে।” তবে, এই দাবি স্থানীয় জনগণ ও ছাত্র সংগঠনগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ইউপিডিএফ: বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিযোগ— ইউপিডিএফ ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতা করে গঠিত একটি আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, যারা পার্বত্য চুক্তির পরও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে। তবে, সংগঠনটির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অপহরণ, চাঁদাবাজি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ২০০১ সালে তিন বিদেশী নাগরিক অপহরণ করে ৩ কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান এডভোকেট শক্তিমান চাকমাসহ ৬ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইউপিডিএফ জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে মিতালী চাকমা নামে এক নারীকে হিল উইমেন্স ফেডারেশনে যোগদান না করার কারণে অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগে ইউপিডিএফ-এর নাম সামনে আসে। মিতালী চাকমা তৎকালীন ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন। এরপর থেকে মিতালী চাকমাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০২৪ সালে রাঙামাটির নান্যাচরে এক গ্রামবাসীকে গুলি করে আহত করার ঘটনাতেও ইউপিডিএফ-এর সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় জনগণ এখন ইউপিডিএফ-কে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করছে। তাদের কর্মকাণ্ড পাহাড়ের শান্তি ও উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল জানিয়েছেন, অপহৃতদের উদ্ধারে মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, “পাহাড়ের একটি আঞ্চলিক সংগঠন এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।” জনমত ও দাবি: পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ এবং ছাত্র সমাজ ইউপিডিএফ-এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। তারা দাবি করছে: ১. অপহৃত শিক্ষার্থীদের নিঃশর্ত মুক্তি, এবং অপহরণের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা। ২. ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ ও সংগঠনটির উপর নিষেধাজ্ঞা। ৩. জনসাধারণ যেনো ইউপিডিএফকে বয়কট করে। ৪. পাহাড়ে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ। বিক্ষোভকারীরা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের মতো সমাজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর হামলা পার্বত্য চট্টগ্রামের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও মানবাধিকারের জন্য হুমকি। ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে অপহরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। শিক্ষার্থী অপহরণের ঘটনা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং পাহাড়ের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদী হুমকি। জনগণের প্রতিবাদ ও বয়কটের ডাক ইউপিডিএফ-এর প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের প্রতিফলন। সরকার ও প্রশাসনের কাছে এখন জরুরি দায়িত্ব হলো অপহৃত শিক্ষার্থীদের নিরাপদ উদ্ধার এবং পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ আর সন্ত্রাসের ছায়ায় বাস করতে চায় না—তারা শান্তি ও নিরাপত্তা চায়। SHARES সারা বাংলা বিষয়: