হাতিয়ার মানচিত্র অক্ষত রাখতে ব্লক নির্মাণ ও নদী ভাঙন রোধ করুন

দেশসেবা দেশসেবা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ৩:৫৬ অপরাহ্ণ, জুলাই ১০, ২০২৪

মামুন রাফী। হাতিয়া উপজেলা নোয়াখালী জেলার একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল, যা বঙ্গোপসাগরের বুকে এবং মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত। অপরূপ সৌন্দর্য আর সমুদ্রের কলকল ধ্বনি যে কারও মনকেই শীতল করে। কিন্তু এ সৌন্দর্যমণ্ডিত দ্বীপ উপজেলাটি প্রতিনিয়ত হার মেনে চলেছে মেঘনা নদীর কাছে।

গত কয়েক দশক ধরে মেঘনা নদীর করাল গ্রাসে ভাঙছে হাতিয়ার জনপদ। কেবল জনপদ ভাঙছে না, ভাঙছে সাজানো অনেক সংসারও। নদীগর্ভে নিজের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে অসহায় মানুষগুলো ছাড়ছে নিজ জন্মভূমি। পাড়ি দিচ্ছে নতুন গন্তব্যে, নতুন করে বাঁচার তাগিদে। অথচ এসব মানুষ একসময় দৃঢ়চিত্তে সংকল্প করেছিল, কখনো ছাড়বে না নিজ জন্মস্থান।

প্রতি বছর মেঘনা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে হাতিয়া উপজেলার হাজার হাজার হেক্টর জমি, যা কেবল হাতিয়ার মানচিত্রের ওপর আঘাত হানেনি, আঘাত হেনেছে হাজারো মানুষের ভাগ্যরেখায়। এমন পরিবর্তনের কারণে দুরবস্থায় নিপতিত ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের বেদনাগুলো কেবল অশ্রু হয়ে আজ ঝরছে।

ভাঙা-গড়ার এ খেলায় অসহনীয় হয়ে পড়েছে এখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবন। নদী ভাঙন প্রতিরোধ করা গেলে হাতিয়ার ভবিষ্যৎ চিত্র হবে অন্যরকম। ধারণা করা যায়, একসময় হাতিয়া হবে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন নগরী। হাতিয়ার দক্ষিণ অঞ্চল তথা নিঝুমদ্বীপ ঘাট থেকে শুরু করে হাতিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব দিক, বিশেষ করে হাতিয়ার উত্তরাঞ্চল দ্রুত ভেঙে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালের শেষের দিকে হাতিয়ার জনগণের নিজ অর্থায়নে জিও ব্যাগ ফেলা হয়। অর্থের সংকটে কাজটি এখনো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।

হাতিয়াকে টিকিয়ে রাখতে ব্লক নির্মাণ একান্ত প্রয়োজন হলেও এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ২০২৩ সালের শুরুতে ৩৮৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার, সেই প্রকল্প ও বাস্তবায়ন আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।

নদী ভাঙ্গনের কারণে প্রতি বছর হাতিয়ার মানুষের প্রায় ৯০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। হারিয়ে যাচ্ছে অগণিত ঘরবাড়ি, বিস্তীর্ণ কৃষি জমি, মসজিদ, মন্দির, মক্তব, মাদ্রাসা, হাট, বাজার, স্কুল, কলেজসহ অনেক স্থাপনা। হাতিয়ায় বসবাসরত সাড়ে ৭ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা রক্ষায় নদী ভাঙ্গন রোধ করা হাতিয়ার সংসদ সদস্যর প্রথম কাজ। কিন্তু এদিকে সংসদ সদস্যর আশানুরূপ কোন পদক্ষেপ না দেখে হতাশ হচ্ছে হাতিয়ার সাড়ে ৭ লাখ নাগরিক।

জানা যায়, ১৯৬৫ সাল থেকে হাতিয়ায় নদী ভাঙ্গন শুরু হয়। ১৯৭০ সাল থেকে তা ব্যাপক গতিতে চলতে থাকে। হাতিয়ায় ইউনিয়ন সংখ্যা ছিল ১১ টি। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে হরণী, চানন্দী ও লক্ষী নামে তিনটি ইউনিয়ন মেঘনা গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

মাত্র ৪৩ বছর ব্যবধানে হাতিয়ার হরণী, চানন্দী, লক্ষী, চর রহিম, চর বদ্ধ, শফিনগর, হোকবাদা, আমিরাবাদ, চর কমলা, চর উদয়, চর মতিন, পাঁচ বাগিচা, বাথানখালী, পালগ্রাম, চৌরঙ্গী, সাত বাড়িয়া, আঠার বেকী, কাউনিয়া, আলাদীগ্রাম, চান্দালী গ্রামসহ নাম না জানা অগণিত স্থানসহ প্রায় ২০০ কিঃ মিঃ ভূমি হারিয়ে গেছে নদীর গহ্বরে।

গত দুই বছরে হাতিয়া উপজেলার সুখচর ও নলচিরা নামে আরো দুইটি ইউনিয়ন নদীগর্ভে অনেকটা বিলীন হয়ে যায়। ৯টি ওয়ার্ড থেকে ইউনিয়নগুলোর রয়েছে মাত্র ১টি ওয়ার্ডের অংশবিশেষ।নদী ভাঙ্গনের কারণে হাতিয়া দ্বীপের মানুষ সু-শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, উন্নত জীবন যাপন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বহুমূখী ভাঙ্গনের কারণে প্রতি বছর প্রায় ৩ শতাধিক বসতবাড়ী হারিয়ে যাচ্ছে হাতিয়ার মানচিত্র থেকে।

এসব বাড়ী ঘরের মানুষ জীবন যাপনের জন্য সাগরের বুকে নতুন জেগে ওঠা চর, খাস জমি ও বেড়ীবাঁধের পাশে আশ্রয় নেয়। যেখানে নেই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা ও আশ্রয়কেন্দ্র। ফলত: প্রতিনিয়ত ঘুর্ণিঝড়, জোয়ার, জলোচ্ছ্বাস এসব অসহায় মানুষের বাঁচার শেষ অধিকারটুকুও যেন কেড়ে নিচ্ছে। হাতিয়ার প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু নদী ভাঙ্গনের ফলে কৃষক হারিয়ে ফেলছে অগণিত কৃষি জমি। এতে করে দিন দিন ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে, বাড়ছে শুধু দারিদ্রতা।

পার্শ্ববর্তী উপজেলা মনপুরাসহ সমুদ্র তীরবর্তী আশপাশের জেলা-উপজেলাগুলোতে ব্লক নির্মাণ প্রায় সম্পন্ন হলেও হাতিয়া উপজেলায় ব্লক নির্মাণে তেমন কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। হাতিয়ার মানচিত্র অক্ষত রাখতে ব্লক নির্মাণের কোন বিকল্প নেই। তা না হলে সহসাই মেঘনা নদীর গর্ভে হাতিয়ার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। হাতিয়া উপজেলায় ব্লক নির্মাণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, হাতিয়ার সংসদ সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।