ইসলামে সন্তান পালন পদ্ধতি

দেশসেবা দেশসেবা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:৪১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৪

মোঃ জোবায়ের হোসেন,পত্নীতলা। মহান আল্লাহ তা’আলা মানুষ সহ সৃষ্টি জগতের খাদ্য নিশ্চিত করেছেন অত্যন্ত হিকমাত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে। পুরুষ জমিনে চাষ করে, নারী রান্না করে খাবার তৈরি করে, আর শিশু সন্তান বিনা পরিশ্রমে মায়ের মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণ করে। মায়ের দুধের মধ্যে আল্লাহ তা’আলা শিশুর কল্যাণ নিহিত রেখেছেন। সন্তানকে দুধ পান করানো, লালন পালন করা, এসব বিষয়ে ইসলাম নারীর জন্য পূণ্য ঘোষণা করেছে। সন্তানকে সুন্দরভাবে লালন পালন করা, তালিম তরবিয়ত করা, শিক্ষা দেওয়া, ইত্যাদি- বাবা মায়ের জন্য সদকায়ে জারিয়া। জাগতিক ও ধর্মীয় উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রেষ্ঠতম কর্ম ও উত্তম ফলাফলের মাধ্যম। “এক হাদিসে এসেছে হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বাচ্চা জন্মগ্রহণ করার পর দুধের যে ফোটা বের হয় আর বাচ্চা যখন তা পান করতে থাকে তখন প্রতি ঢোক এবং প্রতি ফোটাতে নারী নেকি পেতে থাকে। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ৪-র্থ খন্ড/৩৫২পৃঃ)

সৃষ্টির আগেই মাখলুকের খাবারের ব্যবস্থা করা মহান আল্লাহ তায়ালার অনেক বড় দয়া। একজন মা দুধ পান করিয়ে তার তৃষ্ণার্ত-খুধার্ত বাচ্চাকে যেমন তৃপ্ত করতে পারেন, তেমনি মহান আল্লাহ তাআলার নিকট উত্তম প্রতিদানের ও উপযুক্ত হতে পারেন। বাচ্চাকে দুধ পান করানো মহান আল্লাহ তাআলার নিকট অনেক পছন্দনীয় একটি আমল এবং মায়ের জন্য এটি গর্বেরও বিষয়। একজন মায়ের পক্ষ থেকে স্বভাবজাত দাবিও বটে। বিশেষ কোনো অসুবিধা ছাড়া দুধ পান না করালে মহান আল্লাহ তাআলার নিকট জবাবদিহি করতে হবে। অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মহান আল্লাহ তা’আলা পয়গম্বর হযরত মূসা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম এর মাকে নির্দেশ দিলেন তাকে দুধ পান করাতে। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনুল কারিমে এরশাদ হয়েছে, “আমি মুসা জননীকে আদেশ পাঠালাম যে, তাকে স্তন্য দান করতে থাকো, অতঃপর যখন তুমি তার সম্পর্কে বিপদের আশঙ্কা করো, তখন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করো এবং ভয় করো না, দুঃখও করো না। আমি অবশ্যই তাকে পয়গম্বরগণের একজন করব। (সুরা কাসাস-আয়াত নং-৭)

ইসলাম শিশু বাচ্চাকে দুধ পান করানোর প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে। দুধ পান করানোর বিধান বর্ণনা করে মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন, আর সন্তানবতি নারীরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবে, যদি দুধ পানের পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত করতে চায়। আর সন্তানের অধিকারী অর্থাৎ পিতার উপর হল সেসব নারীর খরপোশের দায়িত্ব প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী। কাউকে তার সামর্থের অতিরিক্ত চাপের সম্মুখীন করা হয় না। আর মাকে সন্তানের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না এবং যার সন্তান তাকেও তার সন্তানের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন করা যাবে না। আর ওয়ারিশদের উপর ও দায়িত্ব এই। তারপর যদি পিতা-মাতা ইচ্ছা করেন, তাহলে দুই বছরের ভেতরেই নিজেদের পারস্পরিক পরামর্শ ক্রমে দুধ ছাড়িয়ে দিতে পারে, তাতে তাদের কোন পাপ নেই, আর যদি তোমরা কোন ধাত্রির দ্বারা নিজের সন্তানদেরকে দুধ পান করাতে চাও, তাহলে যদি তোমরা সাব্যস্ত কৃত প্রচলিত বিনিময় দিয়ে দাও তাতেও কোন পাপ নেই। আর আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রেখো যে, আল্লাহ তাআলা তোমাদের যাবতীয় কাজ অত্যান্ত ভালো করেই দেখেন। (সূরা বাকারা-আয়াত নং-১৩৩)

বাচ্চাদের দুধ পান করানোর সর্বোচ্চ সময়সীমা দুই বছর। সূরা বাকারার উপরোক্ত আয়াতটি দাড়াও তাই বোঝা যায়। সূরা আহকাফ এর ১৫ নম্বর আয়াতে এসেছে, ‘তাকে (গর্ভে) ধারণ ও দুধ ছাড়ানোর মেয়াদ হয় ৩০ মাস। মানব শিশুর জীবিত জন্মগ্রহণের সর্বনিম্ন মেয়াদ হল ছয় মাস আর দুধ পান করানোর সর্বোচ্চ মেয়াদ দুই বছর। এ হিসাবে দুই বছর বা ২৪ মাস দুধ পানের সময় হয়। তবে কোন বাচ্চা যদি অতিশয় দুর্বল হয়, তাহলে তাকে প্রয়োজনবশত আড়াই বছর পর্যন্ত দুধ পান করানোর সুযোগ আছে। (ফতাওয়া শামী-৩য়,খন্ড/২০৯পৃঃ) সন্তানের বাবা ও অভিভাবকদের উচিত এ সময় নবজাতক মাকে খুব বেশি সঙ্গ দেওয়া। দুধ পান করানোর সঠিক পদ্ধতি জানিয়ে দেওয়া এবং সুসং খাবারদাবারের ব্যাপারে তাকে সচেতন করা। গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে বাচ্চা প্রসব হওয়া পর্যন্ত প্রসূতি মায়ের যত্ন নেওয়া পরিবারের লোকদের একান্ত কর্তব্য। তবে নিজের সচেতনতাই সবচেয়ে বড়। এ সময় মাকে স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। কারণ, মায়ের প্রভাব শিশুর উপর পড়ে।

মায়ের যেমন কোন উত্তম বিকল্প নেই, ঠিক তেমনি মায়ের দুধেরও কোন বিকল্প নেই। মায়ের দুধ শিশুর জন্য উত্তম খাদ্য। এতে রয়েছে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ ও উপাদান সমৃদ্ধ এমন খাবার, যা শিশু সহজে হজম করতে পারে। এটি মহান রবের কুদরতের অপূর্ব উপহার, অফুরন্ত নিয়ামত। নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও আদর্শ খাবার। মেডিকেল সাইন্স ও একথা স্বীকার করে। মানুষের ব্রেনের যে অংশে খুশি-আনন্দ ও চিন্তা পেরেশানির অবস্থা সৃষ্টি হয়, এর কাছাকাছি অবস্থান করে মায়ের বুকের দুধের কেন্দ্রস্থল। দুধের এই প্রভাব বাচ্চার উপর পড়ে। অনেকে মায়ের বুকে নেমে আসা প্রথম শাল দুধ পান করাতে চান না, এটি একটি নিতান্তই কুসংস্কার। মনে রাখতে হবে, সাল দুধ শিশুর জন্য প্রাকৃতিক টিকা।

মায়ের দুধ শিশুর জন্মগত অধিকার। মায়ের দুধ শুধু নবজাতকের ক্ষুধা ও পিপাসায় মেটায় না, বরং বাচ্চার সঙ্গে দৃঢ় বন্ধন তৈরি করে। মায়ের দুধ পান কারি বাচ্চা জ্ঞানী ও মেধাবী হয়ে থাকে। অনেক রোগ ব্যাধি থেকে নিরাপদে থাকে। নিজেকে রক্ষা করতে পারে। এতে, কোন ধরনের ইনফেকশন দ্বারা বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম। মায়ের দুধ সুস্থ, দুর্বল, অসুস্থ সব ধরনের বাচ্চার জন্য উপকারী। এটা পান করলে বাচ্চা স্বাস্থ্যবান হয়। বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করালে শুধু যে বাচ্চার উপকার হয় তা নয়, বরং নবজাতক মায়েরও রয়েছে বহুবিধ উপকার। সন্তানকে দুধ পান করালে মা নিজেও উপকৃত হন। প্রসব জনিত রক্তপাত দ্রুত বন্ধ হয় পরবর্তী সময়ে রক্তস্বল্পতা হয় না গর্ভ জনিত স্ফীত জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ পান করালে মায়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। যেসব মা শিশুদেরকে বুকের দুধ পান করান, তাদের স্তন,জরায়ু এবং ডিম্বকোষের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। বুকের দুধ পান করালে স্বাভাবিক জন্মনিয়ন্ত্রণে তা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এছাড়া যারা ঘন ঘন গর্ভবতী হতে চান না, তাদের জন্যও তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের আত্মবিশ্বাস বাড়ে, মা ও শিশুর আত্মিক বন্ধন দৃঢ় হয়। মায়ের দুধ মানুষের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে যেন এক মহান কুদরতি মেহমানদারী। মহান আল্লাহ তা’আলা সবাইকে এর কদর বুঝার ও উপকার লাভের তাওফিক দান করুন।