
অরবিন্দ কুমার মণ্ডল।।
মৌসুমের আগেই সুন্দরবনের অপরিণত মৌচাক থেকে জেলেদের চুরি করে মধু সংগ্রহের কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য মৌয়াল এবং বনবিভাগের। সুন্দরবনে এখন ফুল ফোটার মৌসুম। বনের খলিশা, গরানসহ বহু গাছে শোভা পাচ্ছে ফুলে ফুলে। আর ফুল থেকে মৌচাকে মধু জমা করতে কর্মব্যস্ততা বেড়েছে মৌমাছির। মধুর চাকগুলো পরিণত হওয়ার পর আগামী ১ এপ্রিল থেকে মৌয়ালদের মধু আহরণে সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি দেবে বন বিভাগ। বৈধ অনুমতির আগেই জেলের বেশে কিছু অসাধু ব্যক্তি বনে ঢুকে অপরিণত মৌচাক কেটে মধু সংগ্রহ করছেন। এতে পূর্ণ মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত মধু না পাওয়ার শঙ্কায় পড়েছেন মৌয়ালরা। গতকাল বুধবার সরেজমিনে সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, সুন্দরবন থেকে চুরি করে সংগ্রহ করা খলিশা ফুলের মধু চড়া মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে সুন্দরবনে খলিশা ও গরান ফুলের মধু আসে। এরপর আসে বাইন, কেওড়াসহ বিভিন্ন ফুলের মধু। এর মধ্যে সবচেয়ে দামি হচ্ছে খলিশা ফুলের মধু। কয়রা উপজেলার ৫নং কয়রা গ্রামের মৌয়াল আবুল হোসেন জানান, মধু সংগ্রহ করতে মৌয়ালরা আগামী এপ্রিলের ১ তারিখে সুন্দরবনে ঢুকতে বন বিভাগের অনুমতি পাবেন। অথচ মার্চ মাসেই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় ১ হাজার ১০০ টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় প্রতি কেজি সুন্দরবনের মধু বিক্রি হচ্ছে। মূলত বেশি দামের আশায় মাছ ও কাঁকড়া ধরার অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে যাওয়া জেলেরা এসব মধু সংগ্রহ করছেন। এর ফলে কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সময়ে বনে ঢুকে প্রত্যাশিত পরিমাণ মধু সংগ্রহ নিয়ে তারা চিন্তায় পড়েছেন। সম্প্রতি সুন্দরবনে মাছ ধরার অনুমতি (পাস) নিয়ে চুরি করে মধু আহরণের অভিযোগে ছয়জনকে আটক করেছে বন বিভাগ। সুন্দরবনের আন্ধারমানিক টহল ফাঁড়ীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাশেদুল হাসান বলেন, ‘আমরা সুন্দরবনের চামটার খাল ধরে টহল দিচ্ছিলাম। সেখানে জেলেদের তিনটি নৌকা তল্লাশি করে অবৈধভাবে আহরণ করা মধু, মোমসহ আনুসঙ্গিক মালামাল জব্দ করেছি। সেই সঙ্গে নৌকায় থাকা ছয় জেলেকে গ্রেফতার করে বন আইনে মামলা দিয়েছি।’ কয়রার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের মৌয়াল খোকন মন্ডল বলেন, ‘একটা পরিপূর্ণ মধুর চাক থেকে কমপক্ষে পাঁচ–সাত কেজি বা তার বেশি মধু পাওয়া যায়। কিন্তু চোরা মধু আহরণকারীদের আগাম চাক কাটার কারণে চাকে সর্বোচ্চ ৫০০ গ্রাম মধু পাওয়া যায়। এবার বন থেকে যেভাবে মাছ ও কাঁকড়া শিকারের আড়ালে আগাম মধু কাটা হচ্ছে, তাতে মৌসুম শুরু হলে মধু কেমন হবে, তা বলা যাচ্ছে না। বেশি মধু না পেলে আমাদের চালান মার যাবে। তখন ঋণের বোঝা টেনে বেড়াতে হবে।’ কয়রার গোলখালী গ্রামে সুন্দরবনের মধু বিক্রি করছিলেন এক জেলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, কয়েক দিন আগে কাঁকড়া ধরতে সুন্দরবনে ঢুকে তিন কেজি মধু এনেছেন তিনি। মৌসুমের আগেই চাক কাটলে মধু কম পাওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, এখন চাকে ৩০০–৪০০ গ্রাম পর্যন্ত মধু পাওয়া যাচ্ছে। এসব চাক থেকে এপ্রিলের তৃত্বীয় সপ্তাহের দিকে মধু আহরণ করলে সর্বনিম্ন চার কেজি করে মধু পাওয়া যেত। তিনি এখন প্রতি কেজি মধু ১ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন বলে জানান। মধু আহরণে প্রতিবছর বন বিভাগের একটি লক্ষ্যমাত্রা থাকে। বন বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ করা হয়েছিল ৪ হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে ৩ হাজার ৮ কুইন্টাল হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও কমে হয় ২ হাজার ৮২৫ কুইন্টাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। তবে চুরি করে আহরণ করা মধু বন বিভাগের হিসাবের বাইরে থাকে। অন্যদিকে আগাম চাক কাটার কারণে মৌসুমে মধুও কম পাওয়া যায়। এর ফলে বন বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান জানান, ১৮৮৬ সালে সুন্দরবন থেকে মধু আহরণের জন্য অনুমতি (পাস) দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়। আগামী ১ এপ্রিল সুন্দরবনে মধু আহরণ শুরু হয়ে চলবে ৩১ মে পর্যন্ত। তিনি বলেন, ‘মৌসুম শুরুর আগে আগাম মধু চুরির অপতৎপরতা ঠেকাতে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। তা ছাড়া এই কাজে জড়িত কেউ ধরা পড়লে তাঁর পারমিট বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমাদের জনবল কম থাকায় দুয়েকজন বন বিভাগের কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মধু কাটতে পারেন। তবে আমরা সজাগ আছি, ইতিমধ্যে অনেকের নামে মামলাও হয়েছে।’