রাজারহাটের রাম জীবন কুন্ডুসহ অনেকেই অবৈধ মুজিবনগর সার্টিফিকেটে কোটি পতি

দেশসেবা দেশসেবা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:২৯ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১৩, ২০২৪
মহসিন কামাল ।।কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বাসিন্দা রংপুর সদর সাব রেজিস্টার অফিসে বর্তমান কর্মরত রামজীবন কুন্ডুসহ ‘মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে অবৈধভাবে এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন অনেকেই । দুর্নীতি ও জালিয়াতির দায়ে বরখাস্ত হলেও উচ্চ আদালতে গিয়ে চাকরি ফিরে পাওয়াদের মধ্যে একজন রংপুর সদরের সাব-রেজিস্ট্রার রামজীবন কুণ্ডু। তার জন্ম ১৯৬৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ৬ বছরেরও কম। এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সাব-রেজিস্ট্রারদের প্রায় সবার বিরুদ্ধেই অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। চাকরির মেয়াদ আর মাত্র এক থেকে দেড় বছর বাকি থাকায় শেষ মুহূর্তে তাদের লাগামহীন দুর্নীতিতে বিব্রত হচ্ছেন অধিদফতরের অন্য কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে ২০০৯ সালে ১৯০ জনকে সাব-রেজিস্ট্রার পদে আত্তীকরণ করা হয়েছিল উচ্চ আদালতের নির্দেশে। তাদের মধ্যে ১৯৬৮, ১৯৬৭, ১৯৬৬, ১৯৬৫ সালে জন্ম নেওয়া ব্যক্তিরাও ছিলেন যাদের বয়স মুক্তিযুদ্ধের সময় মাত্র ৩ বছর থেকে ৬ বছর ছিল। জালিয়াতির মাধ্যমে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া নিয়ে তখন নিবন্ধন দফতরসহ আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যেও তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। কারণ মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। ওই সরকারের কর্মচারী হতে হলে তাদের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হওয়া বাঞ্ছনীয়। সে ক্ষেত্রে তাদের জন্মসাল হওয়া দরকার ১৯৫২ অথবা তার পূর্বে। কিন্তু নিয়োগ পাওয়াদের সবারই জন্ম তারিখ ছিল ১৯৫৩ সালের পরে। এর মধ্যে ১৩৮ জনের বয়সই ছিল ১০ বছরের নিচে। আর ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সালে জন্ম তারিখ আছে এমন সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ জন। মূলত ৬৪ সালের পর যাদের জন্ম দেখানো হয়েছিল তারাই এখন কর্মরত রয়েছেন এবং আগামী বছর তারা অবসরে যাবেন। তাই শেষ মুহূর্তে দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে মধ্য বয়সে সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে চাকরি পাওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাই রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার লক্ষ্যে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন বলে নিবন্ধন অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন। তারা বলেন, অনেকের তেমন কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার পরও ভুয়া শিক্ষাগত সনদ দেখিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার হয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এবং বেশি বয়সে যোগদান করায় তাদের চাকরি যেহেতু অল্প কয়েক বছরের জন্য তাই তারা এ অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচুর অর্থ সম্পদ বানিয়ে নিচ্ছেন। অনেকেই টাকার বিনিময়ে ব্যক্তির নামে খাস জমি নিবন্ধন, শ্রেণি পরিবর্তন করে ও ভুয়া খাজনা খারিজ নিয়ে জমি নিবন্ধন করছেন। মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীর ভুয়া পরিচয়ে চাকরি নেওয়া এবং দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগে ২০১২ সালে ৩৯ জনকে বরখাস্ত করেছিল মন্ত্রণালয়। তবে উচ্চ আদালতে গিয়ে তাদের অনেকেই আবার চাকরি ফিরে পান। দুর্নীতি ও জালিয়াতির দায়ে বরখাস্ত হলেও উচ্চ আদালতে গিয়ে চাকরি ফিরে পাওয়াদের মধ্যে একজন রংপুর সদরের সাব-রেজিস্ট্রার রামজীবন কুণ্ডু। তার জন্ম ১৯৬৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ৬ বছরেরও কম। এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
একইভাবে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া গাজীপুর সদরের সাব-রেজিস্ট্রার মো. জাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক ঘুষ-দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। ভুয়া সনদ দেখিয়ে চাকরিতে আত্তীকরণ হওয়া এ সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় কর্মরত থাকাকালে গাজীপুরের শত শত একর বনভূমি মোটা অঙ্কের উৎকোচ নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তির নামে দলিল রেজিস্ট্রি করে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুদক দুটি মামলা করেছে। রাজধানী ঢাকায় একাধিক বাড়ি, গাড়ি ও মার্কেটের মালিক তিনি। ডিগ্রির ভুয়া সনদ দেখিয়ে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পর ২০১৮ সালের ৪ জুলাই দুদকের উপসহকারী পরিচালক আহামদ ফরহাদ হোসেন বাদী হয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলাটি করেছিলেন। নাম পরিবর্তন করে ব্যাংক হিসাব খোলার অভিযোগও আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু তার পরও তিনি দাপটের সঙ্গে চাকরি করে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মাত্র ৫ বছর বয়স থাকার পরও মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে চাকরি পাওয়া কিশোরগঞ্জ সদরের সাব-রেজিস্ট্রার মিনতি দাস গাজীপুর সদরে থাকা অবস্থায় সকালে একটি জমি প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্য দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করেন এবং মাত্র ১ ঘণ্টা পর পরবর্তী দলিলে ২২ কোটি টাকা মূল্য দেখিয়ে ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ দলিল করে দেন। এভাবে তিনি দলিলদাতাকে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকার পল্লবী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দায়িত্বে থাকাকালে ২০১৯ সালের ৮ আগস্ট ৪৯৬১ নং সাফ কবলা দলিল রেজিস্ট্রির সময় শ্রেণি পরিবর্তন করে সরকারের ৫৩ লাখ ১১ হাজার ১৪৮ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দেন। বর্তমানে কিশোরগঞ্জেও জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে প্রচুর দলিল করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে, যা দুদক তদন্ত করছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জ সদরের সাব-রেজিস্ট্রার মিনতি দাস কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।একই ধরনের অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে উত্তরার সাব-রেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লা, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রার খোন্দকার গোলাম কবির, গাজীপুরের কালিয়াকৈরের নুরুল আমিন তালুকদার, টঙ্গীর আবু হেনা মোস্তফা কামাল, নরসিংদী সদরের সোহরাব হোসেন সরকার, চট্টগ্রামের রাউজানের আবু তাহের মো. মোস্তফা, সিরাজগঞ্জ সদরের আবদুর রশিদ মণ্ডল, বরিশাল সদরের সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল ও সাব-রেজিস্ট্রার ইফসুফ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের সবার বয়সই ছিল মাত্র ৫ থেকে ৬ বছর। কিন্তু তারপরও মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে চাকরি নেওয়ার পর এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুদকে অভিযোগ আসার পর তদন্ত হচ্ছে।অভিযোগের বিষয়ে সাব-রেজিস্ট্রার একেএম ফয়েজ উল্লাহ বলেছেন, সাব-রেজিস্ট্রার পদে চাকরি নেওয়ার পর তিনি কোনো সম্পদ অর্জন করেননি। তাদের আগের যেসব জমিজমা, প্লট ও ফ্ল্যাট ছিল, তা বিক্রি করে সেই টাকা তারা ব্যাংকে লেনদেন করেছেন। তাই তাদের কোনো অবৈধ সম্পদ নেই।আইন মন্ত্রণালয় ও নিবন্ধন অধিদফতরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এ সাব-রেজিস্ট্রাররা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কত সালে পাস করেছেন, মুক্তিযুদ্ধকালে কোন সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, মুজিবনগর সরকারে তারা কোন পদে কর্মরত ছিলেন তার কোনো তথ্য মন্ত্রণালয় বা নিবন্ধন অধিদফতরের কাছে নেই। মন্ত্রণালয় শুধু উচ্চ আদালতের নির্দেশে একটি তালিকা পেয়ে তাদের আত্তীকরণ করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিবন্ধন অধিদফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. আবদুস ছালাম আজাদ সময়ের আলোকে বলেন, মুজিবনগর কর্মচারী হিসেবে সাব-রেজিস্ট্রার পদে আত্তীকরণ হওয়া কর্মকর্তাদের শিক্ষাগতসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত কোনো তথ্য অধিদফতরে থাকে না। এটা নিয়োগকারী মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকার কথা। তবে তাদের উচ্চ আদালদের নির্দেশে মন্ত্রণালয় অধিদফতরে পদায়ন করেছে। তারা যোগদান করার পর তাদের জন্য ফাইল খোলা হয়েছে। তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারও বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।