দুবলারচরে ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসব শুরু আজ

দেশসেবা দেশসেবা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১:১১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৪, ২০২৪

অরবিন্দ কুমার মণ্ডল।।সুন্দরবনের দুবলারচরে শত বছর ধরে উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসব। তারই ধারাবাহিকতায় (২০২৪ সাল) আজ ১৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মঙ্গল ঘট স্থাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে তিন দিনের রাসপূর্ণিমার রাস উৎসব।তবে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে এ সময় পুণ্যার্থী ছাড়া অন্য কেউ সুন্দরবনে ভ্রমণ করতে পারবেন না। এ ছাড়া উৎসবকে কেন্দ্র করে এবারও বসবে না মেলা।খুলনার কয়রা উপজেলার আওতাধীন সুন্দরবনের কোবাদক ফরেস্ট স্টেশন থেকে অনুমতি নিয়ে রাসপূজায় যোগ দিতে আজ সকালে রওনা হয়েছে ৪০ জনের একটি পুণ্যার্থী দল। ঐ দলের একজন সুব্রত কুমার মণ্ডল। তিনি জানান, এক সপ্তাহ আগে থেকে প্রস্তুতি পর্ব শেষ করেছেন তাঁরা। মাঝারি আকারের ট্রলারটি ৩ দিনের জন্য ৩২ হাজার টাকায় ভাড়া করেছেন। তিন দিনের জন্য বাজারসদাই করে আজ সকালে ট্রলার নিয়ে দুবলারচরের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন সবাই।দুবলারচরের রাসপূজা ও মেলা উদ্‌যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ বসু বলেন, ‘রাসপূজা উপলক্ষে আমাদের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। তিথি অনুযায়ী আজ পূজা-অর্চনা শুরু হচ্ছে। আগামী শনিবার ভোরে পুণ্যস্নান হবে। এবারও রাসমেলা হচ্ছে না।বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, পুণ্যস্নানে নিরাপদে যাতায়াত নিশ্চিত করতে তীর্থযাত্রীদের জন্য এবার পাঁচটি অনুমোদিত রুট বা পথ নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব পথে বনরক্ষীদের টহল দল সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছেন। বনে প্রবেশের সময় নৌযানের প্রবেশ ফি, অবস্থান ফি ও লোকের সংখ্যা অনুযায়ী পাস দেওয়া হচ্ছে। তীর্থযাত্রীরা পছন্দমতো একটি রুট ব্যবহার করতে পারবেন। বন বিভাগের চেকিং পয়েন্ট ছাড়া কোথাও নৌযান থামানো যাবে না। এ ছাড়া এবারও উৎসবকে কেন্দ্র করে হচ্ছে না রাসমেলা। ২০২১ সাল থেকে রাস উৎসবে মেলা বন্ধ রয়েছে।কয়রার থেকে রাসপূজায় গিয়েছেন সুদীপ্ত দত্ত। তিনি বলেন, ‘আমি এবার দিয়ে তিন বছর রাসপূজায় যাচ্ছি। পূর্ণিমায় সাগরের জোয়ারের লোনাজলে স্নানের মধ্য দিয়ে পাপমোচন হয়ে মনস্কামনা পূর্ণ হবে—এ বিশ্বাসে আমরা পূজায় যোগ দেই।বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান যুব ঐক্য পরিষদ খুলনা জেলা শাখার সহ-সভাপতি ও কয়রা উপজেলা শাখার সভাপতি, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ খুলনা জেলা শাখার সদস্য শিক্ষক অরবিন্দ কুমার মণ্ডল বলেন, শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুসারী হরিভজন পাগল নামের এক সাধু ১৯২৩ সালে সুন্দরবনের দুবলারচরের আলোরকোলে প্রথম রাসপূর্ণিমার পূজা শুরু করেন। ২৪ বছরের বেশি সময় ধরে এই সাধু একা একা বনে অবস্থান করে পূজা উদ্‌যাপন করতেন। দুই যুগের অধিককাল বনের ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণ করেন তিনি। এর পর থেকে সনাতন ধর্মের লোকেরা প্রতিবছর রাসপূর্ণিমার পূজার জন্য ছুটে যান সেখানে। সনাতনীদের এই রাসপূজা ধীরে ধীরে রাসমেলায় পরিণত হয়।তিনি আরো বলেন, একটি উপাখ্যানে উল্লেখ আছে অনেক দিন আগের কথা বঙ্গদেশে গণপতি নামে এক সওদাগর ছিলেন। তিনি সমবিহারে সিংহল যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখতে পান সমুদ্রের উপরে ফুটে রয়েছে এক মোহনীয় পদ্মফুল। আর সেই পদ্ম ফুলের উপর দাঁড়িয়ে আছেন এক অপরূপা দেবী। সওদাগর এই ঘটনা সিংহলের রাজা শালবিহার এবং মন্ত্রী গজাননের কাছে বর্ণনা করলে সওদাগরের কথা অবিশ্বাস করে দেবীদর্শনে সমুদ্রে রওনা দেন। সমুদ্রের মধ্যে সওদাগরের তরী ডুবে গেলে দেবী কমল কামিনী পদ্মে ভেসে এসে তাদের উদ্ধার করে কুঙ্গা নদীর মোহনায় এসে পৌঁছে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। এই ঘটনার পর সওদাগর এবং রাজা, দেবী কমলকামিনীর পূজা করেন। ঐ কুঙ্গা নদীর তীরই হচ্ছে দুবলারচর। আর সেদিন ছিল রাস পূর্ণিমা তিথি। তাই সেখান থেকেই রাস পূর্ণিমার পূজা শুরু হয়েছে বলে মনে করা হয়।কথিত আছে “কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পাপমোচন ও পুর্ণ লাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নদেশ পান। এই স্বপ্নাদেশ অনুসারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গঙ্গাস্নান করেন। সেদিন ছিল রাস পূর্ণিমা তিথি। সেই থেকেই শুরু হয় রাস পূর্ণিমা বলে ধারণা পৌরাণিকদের।অন্য অন্যদিকে মনে করা হয় দূর্গাপূজার পর পূর্ণিমাতে বৃন্দাবনবাসী গোপিদের সাথে লীলায় মেতে ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আর সেই থেকে কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় রাসলীলা পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর কার্তিক- অগ্রহায়নের শুক্লপক্ষের ভরা পূর্ণিমায় সাগর যখন উছলিয়ে ওঠে, লোনা পানিতে ধবল চন্দ্রলোক ছলকে যায় অপার্থিব সৌন্দর্য রচনা করে। চন্দ্রিমার সেই আলোকমালায় সাগর- দুহিতা দুবলার চরের আলোরকোল মেতে ওঠে রাস উৎসবে।সেদিন সূর্য ওঠার আগেই দুবলারচরের আলোর কোলে সমুদ্র সৈকতে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনায় বসেন পূন্যার্থীরা। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সমুদ্রের জোয়ার শুরু হয়। জোয়ারের পানি পূর্ণার্থীদের স্পর্শ করলেই স্নানে নামেন তারা।প্রতিবছর রাসমেলায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সুন্দরবনের দুবলারচরে সমবেত হন। তবে এ সময় হরিণ শিকারও বেড়ে যায়, যা বন বিভাগের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ জন্য ২০২১ সাল থেকে রাস উৎসবে হিন্দু সম্প্রদায় ব্যতীত অন্যদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় বন বিভাগ।খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, রাস উৎসবে অংশ নিতে কোনো ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র বা অবৈধ সামগ্রী বহন নিষিদ্ধ। পাশাপাশি কারও কাছে হরিণ মারার ফাঁদ, কুঠার, করাত ইত্যাদি পাওয়া গেলেও আইনি ব্যবস্থা নেবে বন বিভাগ। এ ছাড়া একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক, যেমন পানির বোতল, প্লেট, গ্লাস, চামচ বহন করা যাবে না। মাইক বাজানো বা শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের এসব নির্দেশনা মেনে চলার জন্য অনুরোধ করেছে তিনি।সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এম এ হাসান বলেন, বন বিভাগের নিয়ম মেনে আজ সকাল থেকে পুণ্যার্থীরা সুন্দরবনের দুবলারচরের আলোরকোলে যাচ্ছেন। রাসপূজাকে ঘিরে কোনো অপরাধী চক্র যাতে মাথাচাড়া না দিতে পারে, সে জন্য বন বিভাগ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।