ক্ষমতার দাপট, স্বজনপ্রীতি ও নৈতিক অবক্ষয়ের এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত: লালপুরে ‘এটেম্পট টু মার্ডার’ ও প্রকাশ্যে নির্যাতনের ঘটনা

দেশসেবা দেশসেবা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ৩:৫৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৩, ২০২৫

 মোঃ শাহ্ জালাল মাসিম ।।

২০২০ সালের পরবর্তী সময়ে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুর পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ড শিবপুর (ঘোষপাড়া) এলাকায় সংঘটিত হয় এক মধ্যযুগীয় বর্বরতার ঘটনা, যা মানবতা, ন্যায়বিচার ও সামাজিক নিরাপত্তা — সবকিছুকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

ভুক্তভোগী মাসুম (৪২), যিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হলেও গভীরভাবে ইবাদত ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনে নিয়োজিত ছিলেন, হঠাৎই পরিবারের স্বজনদের হাতে অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। ২০০২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করা মাসুম দীর্ঘদিন একাকী বাসায় ইবাদতে মগ্ন ছিলেন।

ঘটনার বিবরণ

একদিন বাইরে থেকে ডাকার শব্দে মাসুম ঘর থেকে বের হলে তাঁর আপন বড় বোনের স্বামী, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সার্জেন্ট শহিদুল স্বপন, তাদের একমাত্র ছেলে শাহিনুর স্বরূপ (১৯) এবং ভুক্তভোগীর আপন বড় ভাই, স্থানীয় বিএনপি কর্মী কবি মামুন চিশতী (৪৭) তাকে ধরে অমানবিক নির্যাতন শুরু করে।

২ ফুট লম্বা মোটা বাঁশ দিয়ে আঘাতে তার হাত ভেঙে যায়, আঙুল কেটে যায়, দুই পা থেতলে যায়। মাথায় দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে রক্ত ঝরে পড়ে, চুল রক্তে লাল হয়ে যায়।

এরপর মোটা রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে কয়েকশ মিটার মাটিতে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। স্থানীয়দের উপস্থিতিতেই ভুক্তভোগীকে আমগাছের সাথে বেঁধে রেখে ইচ্ছেমতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, এই সময়ে তার ওপর যৌন নিপীড়নও ঘটে।

ঘটনায় আরেক আত্মীয়, প্রাক্তন কাউন্সিলর ও স্থানীয় বিএনপি নেতা সাহাবাজ আলীও জড়িত ছিলেন। ক্ষমতার দাপটে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে ধামাচাপা পড়ে যায়, যদিও স্থানীয় অনেকে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

অভিযুক্তরা বিভিন্ন সময়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনুসারী ছিলেন, যা ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে অপরাধ আড়াল করার সুযোগ দিয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে এই রাজনৈতিক দোদুল্যমানতা শুধু আইনশৃঙ্খলার অবক্ষয়ই নয়, বরং অপরাধীদের জন্য রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইসলামি দৃষ্টিকোণ

কুরআনুল কারিমে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—

“যে কেউ একজন মানুষকে হত্যা করল—সে যেন সমস্ত মানবজাতিকে হত্যা করল, আর যে একজনকে রক্ষা করল—সে যেন সমস্ত মানবজাতিকে রক্ষা করল।”
(সূরা আল-মায়িদাহ ৫:৩২)

নবীজী মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন—

“মুমিন মুসলমানের ওপর মুসলমানের রক্ত, সম্পদ ও ইজ্জত হারাম।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: 2564)

অতএব, এই ঘটনা ইসলামের মৌলিক মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের নীতিকে চরমভাবে লঙ্ঘন করেছে।

সামাজিক প্রভাব ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

এমন ঘটনা শুধু একজন ব্যক্তির ক্ষতি করে না, বরং গোটা সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে। আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়, ক্ষমতাবানদের জন্য দায়মুক্তি সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের হাতে এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে, যা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।

উপসংহার:
এটি শুধু একটি পারিবারিক বিরোধ বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়; বরং ক্ষমতার অপব্যবহার, নৈতিক অবক্ষয় ও বিচারহীনতার এক জঘন্য উদাহরণ। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে এ ধরনের অপরাধ সমাজে আরও বিস্তার লাভ করবে।