বাংলাদেশের রাজনীতির সামনে আশঙ্কা ও সম্ভাবনা দেশসেবা দেশসেবা ডেস্ক রিপোর্ট প্রকাশিত: ৫:০৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৩, ২০২৫ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন গত একবছর ধরে অভূতপূর্ব অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। শেখ হাসিনা দীর্ঘ শাসন শেষে দেশত্যাগ করেন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় অর্থনীতিবিদ ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয় এবং প্রতিশ্রুতি দেয় একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের। সেই নির্বাচনের সময় এখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে—আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। এই ভোটকে ঘিরে যেমন মানুষের প্রত্যাশা তেমনি শঙ্কাও কম নয়। বিপ্লব থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জুলাই বিপ্লবের সময় লাখো মানুষ রাজপথে নেমে আসে। সেই আন্দোলনের দাবি ছিল কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি থেকে মুক্তি, দুর্নীতি ও দমননীতির অবসান। ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন এবং আওয়ামী লীগ কার্যত নেতৃত্বহীন অবস্থায় পড়ে। এরপর জাতীয় সংলাপ ও আন্তর্জাতিক চাপে ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। সরকার ঘোষণা দেয়, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। দমননীতি বনাম জনআন্দোলন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দেখা দেয় উত্তেজনা। বিশেষ করে Operation Devil Hunt নামের অভিযানে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থক গ্রেপ্তার হন। ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়ায়। অন্যদিকে ছাত্র ও সাধারণ মানুষ Bulldozer March এর মতো কর্মসূচি নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতীক ও প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করে। ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। একদিকে আন্দোলনের আগুন, অন্যদিকে কঠোর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা—এ দুটি মিলেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও তীব্রতর হয়। আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়া: বহুদলীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ প্রশ্নে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এসে সরকার আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধনও বাতিল করে দেয়। ফলে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের প্রধান দুটি দলের একটি কার্যত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বাদ পড়ে যায়। এতে একদিকে বিরোধীদের জন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্র প্রসারিত হলেও গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত বহুদলীয় প্রতিযোগিতার চেহারাটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক আন্তর্জাতিক মহলও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে—প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বাদ দিয়ে নির্বাচনের বৈধতা কতটা দৃঢ় হবে? নির্বাচনের তারিখ ও রাজনৈতিক চাপ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রথমে এপ্রিল ২০২৬-এ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব দেন। তবে বিরোধীদল ও নতুন রাজনৈতিক জোটগুলোর দাবির মুখে তিনি ঘোষণা দেন—ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর প্রথম সপ্তাহেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশনও এই সময়সূচি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেছে। সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল স্পষ্ট করে বলেন, ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে এবং এতে কোনো পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচনকালীন অনিশ্চয়তার অবসান ঘটলেও রাজনৈতিক ময়দানে উত্তেজনা কমেনি। বিচার ও রাজনীতি একসঙ্গে চলছে অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। সমর্থকরা একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা বললেও বিরোধীরা মনে করছে, দীর্ঘ শাসনকালে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহি হওয়া প্রয়োজন। বিচার প্রক্রিয়া নির্বাচনের পরিবেশকেও সরাসরি প্রভাবিত করছে—কারণ আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ অবস্থায় তাদের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক সহনশীলতার সংকট বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো সহনশীলতার অভাব। দলগুলো প্রতিপক্ষকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, শত্রু মনে করে। যার ফলে প্রতিবার নির্বাচনের আগে সহিংসতা, দমননীতি, গ্রেপ্তার–মামলা চলতেই থাকে। এবারও সেই চিত্র বদলায়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনে মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো আস্থার সেতুবন্ধন তৈরি হয়নি। তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে যে তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রধান চালিকা শক্তি। তারা চায় কর্মসংস্থান, দুর্নীতিমুক্ত শাসন, প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক রাষ্ট্র এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তরুণদের অংশগ্রহণ ও তাদের ভোটই অনেকাংশে নির্ধারণ করবে রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা। আন্তর্জাতিক চাপ ও কূটনৈতিক তৎপরতা বাংলাদেশের নির্বাচনের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের নজরও বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন—সবার স্বার্থ জড়িত রয়েছে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার সঙ্গে। তারা চাইছে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হোক। ইতিমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা নির্বাচনের পরিবেশ পর্যবেক্ষণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ যদি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে পারে, তবে বৈদেশিক আস্থা ও বিনিয়োগ ফেরত আসতে পারে। আর ব্যর্থ হলে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা শুরু হবে।বাংলাদেশের সামনে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠান নয়—এটি দেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনার জন্য একটি নির্ধারক মুহূর্ত। প্রশ্ন হচ্ছে, এই নির্বাচন কি সত্যিকার অর্থে সব দলের অংশগ্রহণে, মানুষের আস্থায় এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হবে? যদি নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হয়, তবে এটি বাংলাদেশের জন্য নতুন আশার দ্বার খুলে দেবে। অন্যদিকে যদি এটি আংশিক বা একপেশে প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়, তবে আবারও আন্দোলন, সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ফিরে আসবে। গণতন্ত্র রক্ষার এই শেষ সুযোগে সব রাজনৈতিক পক্ষকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। জনগণ পরিবর্তন চায়, আস্থা চায়—এবার নির্বাচনের মাধ্যমে সেই প্রত্যাশা পূরণ হবে কিনা, সেটিই সময় বলে দেবে। শরিফুল খান প্লাবন।। SHARES সারা বাংলা বিষয়: