মেহেরপুরে কুমড়ার বড়ি তৈরির ধুম দেশসেবা দেশসেবা ডেস্ক রিপোর্ট প্রকাশিত: ৫:১২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪ মাহাবুল ইসলাম গাংনী ।।প্রতিটা অঞ্চলে নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য থাকে। তেমনিভাবে মেহেরপুর জেলাও এদিক থেকে অনেক সমৃদ্ধ, রয়েছে অনেক ঐতিহ্য। যার মধ্যে একটি হলো মেহেরপুরের “কুমড়ার বড়ি”। জেলায় এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে কুমড়ার বড়ি দেওয়া হয় না। হেমন্তের মাঝামাঝি সময় থেকেই চলছে কুমড়ার বড়ি দেওয়ার ধুম। যা চলবে শীতের শেষ অবধি।মেহেরপুর সদর, গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার প্রতিটা গ্রামের বাড়ির ছাদে, টিনের চালে, বাড়ির পাশে মাঠের মধ্যে চেয়ারের উপর অথবা মাচা তৈরি করে তার উপর কুমড়ার বড়ি শুকাতে দেওয়া অবস্থায় দেখা মিলবেনা এমন গ্রাম নেই বললেই চলে। তাইতো মেহেরপুরের অতীত ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিটা গ্রাম থেকে শহরের সকল বয়সী মা-বোনেরা ব্যস্ত সময় পার করছেন বড়ি দেওয়া নিয়ে।এ বড়ি তৈরিতে প্রয়োজন হয় চাল কুমড়া আর মাস কলাইয়ের ডাল। চাল কুমড়া না থাকলে অবশ্য মাস কলাইয়ের সাথে মুলা, পেঁপে, পেঁয়াজ, পাতা কপি ও ফুলকপি দিয়েও এ বড়ি তৈরি করে থাকে গৃহিণীরা। বড়ি তৈরিতে মেহেরপুরের প্রায় সকলেই এক একটা কারিগর। মা,খালা, ফুফু কিংবা শাশুড়িদের দেখে সকলেই এখন বড়ি তৈরির কারিগর হয়ে গেছেন।হাড়াভাঙ্গা গ্রামের মিমপী জানান, বড়ি তৈরি করতে হলে প্রথমেই সংগ্রহ করতে হবে কলাইয়ের ডাল। পরে তা যথারিতি কুলা দিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে চাকি দিয়ে ভেঙে নিয়ে আবারও পরিষ্কার করতে হবে। এরপর তা নির্দিষ্ট একটি পাত্রে পানি দিয়ে ৬/৭ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে পুকুর, বিল কিংবা নদ-নদীর পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। এরই মাঝে চাল কুমড়া কিংবা মুলা বা পেঁপে যেটাই বলেন সেগুলো ঝিনুক কিংবা চামচ দিয়ে কুরে নিতে হবে। পরে তা টিউবওয়েলের পরিষ্কার পানিদ্বারা ভালোভাবে ধৈত করে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে চিপে পানি বের করে একটি পাত্রে আলগে রাখতে হবে। পরদিন ভোরবেলা কলাইয়ের ডাল ও কুমড়ার ঝুরিগুলো একসাথে ঢেঁকি কিংবা পাটা নুড়াতে পিষে (পেস্ট) করতে হবে। ঢেঁকিতে এ কাজটি করতে পারলে বড়ি বেশি সুস্বাদু হয়ে থাকে। তবে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে ঢেঁকির ব্যবহার না থাকায় এখন যেকোন রাইস মিলেই এসব উপকরণ মেশিনে পেস্ট করা হয়ে থাকে। পেস্ট হয়ে গেলে এরপর হাত দিয়ে যথারীতি ভালোভাবে আটা-ময়দার মতো শেনে নিলেই তা বড়ি তৈরির উপযোগী হবে। তবে যতবেশি শানা হবে ততই বড়ি সুন্দর হবে বলে জানান মাইলমারী গ্রামের ফারহানা।বড়ি তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে হাল চাষের মই, যার উপর বাঁশের তৈরি একটি বাড়ের প্রয়োজন। বাড় বর্তমানে শহরের বাজার ছাড়াও গ্রামের অধিকাংশ এলাকায় ভ্রাম্যমান ব্যবসায়ীরা বিক্রি করে থাকে। ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা হলেই তা কেনা সম্ভব। তাছাড়া কলাইয়ের ডালও গ্রামের কৃষক ও বাজারে কিনতে পারবেন ১’শ ৩০ টাকা কেজি দরে। আর চাল কুমড়া গ্রামের সকল বাড়িতেই কমবেশি হয়ে থাকে। না থাকলে ২’শ থেকে সর্বোচ্চ ১২’শ টাকায় প্রতিটা কুমড়া কেনা সম্ভব।পরে মইয়ের উপর বসানো বাড়ের উপর বড়ি দেওয়া শুরু করতে হবে। কোন কোন গৃহিণীরা মাছ ধরা বিত্তি ও শাড়ী-লুঙ্গির উপরও এসব বড়ি দিয়ে থাকেন। গ্রামের মা-বোনেরা বড়ি তৈরিতে একে অপরকে সহযোগী হিসেবে ৩/৪ জন একত্রে বসে বড়ি দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে বাড়ির ছাদের উপর বসে বড়ি দেওয়ার চিত্র চোখে মেলে। বড়ি তৈরি শেষে ৪/৫ দিন রোদে শুকানোর পর তা খাওয়ার উপযোগী হয়। তবে যতো বেশি শীতে বড়ি তৈরি করা হবে তা খেতে ততই বেশি সুস্বাদু হবে বলে জানান একই গ্রামের লাইলী।একারণেই মেহেরপুরের গৃহিনীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন আগামী ১ বছরের জন্য বড়ি তৈরিতে। বড়ি শীতকালে মাছ, বেগুন, মুলা ও আলুসহ সকল ধরনের সবজির সাথে রান্না করে খেতে অনেক মজাদার। মেহেরপুরের বড়ি রাজধানীসহ দেশজুড়ে সমাদৃত। দেশের যেখানে যার আত্মীয়স্বজন রয়েছে সকলের কাছেই তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আতিথেয়তায় বড়ি উপহার দেওয়া হয়ে থাকে। মেহেরপুরের বাজারেও ৪’শ-১২’শ টাকা দরে প্রতি কেজি বড়ি বিক্রি হয়ে থাকে। এটি শুধুমাত্র প্রিয় খাবারই নয়। এটি জেলার একটি ঐতিহ্য, যা সারা বছর মানুষের প্রিয় খাবার হিসেবে আনন্দ ধরে রাখে। তবে এ ঐতিহ্য হারিয়ে যাবার পথে কারণ নতুন প্রজন্মের মেয়েরা বড়ি তৈরিতে আগ্রহী না। তারা মায়ের বাড়ি থেকে বড়ি এনেই শ্বশুর বাড়িতে চাহিদা পূরণ করছেন। এতে করে তারা এ রেওয়াজ থেকে পিছিয়ে পড়ছে। তবে সকলে মিলে চাইলেই যুগ যুগ ধরে এ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন লক্ষীনারায়নপুর গ্রামের আনোয়ারা, পশ্চিম মালসাদহ গ্রামের আয়েশা খাতুন, মাইলমারী গ্রামের আসমা খাতুনসহ হ্যাবলপুরের কয়েকজন গৃহিণী। SHARES সারা বাংলা বিষয়: