জুমা ও জামাত স্থগিত নিয়ে আগাম-বিতর্ক কেন?

দেশসেবা দেশসেবা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৫৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৩, ২০২০

আগে ফতোয়া দিতেন তাকওয়াসম্পন্ন প্রাজ্ঞ মুফতিরা। তাদের ফতোয়া প্রচার করতেন তরুণরা। এখন যুগ পাল্টেছে। ভূমিকাও উল্টে গেছে। যারা ঠিক মুফতি নন, ফতোয়ার অনুলিপিকার মাত্র, তারাই বক্তৃতার মঞ্চে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুঝে-না বুঝে ফতোয়া দেন, তারপর লবিং ও লিংকের সূত্র ধরে সেই কথাগুলোই একটু রাশভারি ভাষায় বের হয়ে আসে মুরুব্বিদের নামে। (জানি না আদৌ এসব মুরুব্বিদের কথা কিনা। এখনো মুরুব্বিদের বিবেচনায় আমাদের শ্রদ্ধা আছে)।

বিশ্বজুড়ে করোনা যখন ক্রমশ আতঙ্ক বাড়িয়ে চলেছে, তখন দেখলাম কিছু আবেগী বাস্তবজ্ঞানস্বল্প তরুণ বক্তা ও ফেসবুকার আগাম ফতোয়া দিতে শুরু করলেন : বিপদ থাকা বাঁচার জন্য মাদরাসা বন্ধ নয়, খোলা রাখা দরকার। মাদরাসায় দোয়া-রোনাজারি বাড়ানো দরকার। ২৪ ঘন্টার গড়িমসির পর মিডিয়ায় সিদ্ধান্ত এলো একইসুরে। বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন অনেক আলেমের কাছেই সেটা পছন্দ হয়নি। অনেকেই, এমনকি নীতিনির্ধারক মুরুব্বিদের কেউ কেউ ‘হাইয়া’র সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নিজ প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলেন। এরও আটচল্লিশ ঘন্টা পর বোর্ড তার সিদ্ধান্ত বদলে মাদরাসাগুলো বন্ধের নির্দেশনা জারি করল। সুমতির জন্য আমরা হাঁফ ছাড়লাম। সাধুবাদ দিলাম। শুধু মনে মনে আফসোস করলাম : ‘সেই তো নখ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি?’।

তারপর আরববিশ্বে জনসমাগম এড়াতে জুমা ও জামাত বিষয়ে সিদ্ধান্ত এলো। গ্লোবাল ভিলেজের যুগে মুহূর্তেই এটা চলে এলো জনগণের সামনে। আরববিশ্বের
বিজ্ঞ আলেমদের ফতোয়াও আসতে থাকল একের পর এক। (আমি নিজে অন্তত পাঁচটি দেশের শীর্ষ মুফতির ফতোয়া দেখেছি)। এদিকে আমাদের দেশেও নানা বিধিনিষেধ বাড়তে লাগল। সবশেষ একটু আগে ব্যাপক আকারে প্রায় লকডাইন ঘোষিত হলো। কিন্তু এখনো সেভাবে ফুল লকডাইন হয়নি। গার্মেন্টসসহ কলকারখানা সবই চলছে, তাই বিজ্ঞচিত হত আমরা এভাবে বললে :

আরব আলেমরা তাদের দেশের জন্য তাদের অবস্থা অনুযায়ী ফতোয়া দিয়েছেন। আমাদের দেশে আমরা এখনো তেমন ফতোয়ার সময় এসেছে বলে মনে করছি না। তা না করে আমরা আরব আলেমদের ইহুদি-খ্রিস্টানদের দালাল, তাগুত রাজার গোলাম বলে বলে ওপরের দিকে থুথু মারতে থাকলাম। নিজেদেরই অসম্মানিত করতে শুরু করলাম। শুধু তাই নয়, নানা ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে মিছিল-আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দিলাম। গত জুমায় রাষ্ট্রের কর্তাদের জনগণের সুরক্ষা দেওয়ার ফরজ দায়িত্ব যত না স্মরণ করিয়ে দিলাম, তারচেয়ে বেশি হুংকার দিলাম অদৃশ্য ইহুহি-খ্রিস্টানদের দালালদের বিরুদ্ধে। এমনকি এতদিনের নিজেদের প্রিয় পীরে কামেল ড. মুশতাক সাহেব টিভি টকশোতে সরকারি দায়িত্বশীলতার জায়গা একটু বললেন, ‘শরিয়ত প্রয়োজনে অনেক ছাড় দেয়। শরিয়ত নিষিদ্ধকেও বৈধ করে প্রয়োজনের খাতিরে।’ অমনি তাকেও বললাম, ইহুদিদের দালাল!

শুধু কি তাই? চোখ-কান খোলা যেসব পড়াশোনা করা আলেম বুঝতে পারছেন আমরাও আসলে অন্য দেশের মতো পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি, তাদের কণ্ঠ রোধ করার জন্য আগে থেকেই ‘অদৃশ্য ঢিল’ আসতে লাগল : ‘এরা কওমির নব্য সুশীল।’ ‘এরা কওমির ঘরে ইহুদিদের দালাল।’ হায় ইসলাম! নির্ঘাত মৃত্যু ভয়ে যুদ্ধের ময়দানে লা ইলাহা বলল একজন। তাকে হত্যা করলেন সাহাবি। নবীজি (সা.) বললেন, ‘কালেমা বলার পরও তুমি তাকে হত্যা করলে!’ সাহাবি বললেন, সে মন থেকে বলেনি। নবীজি (সা.) ব্যথা আর বিস্ময় নিয়ে বললেন : ‘তুমি তার কলব টুকরা করে দেখেছ?!’ এই হাদিস পড়েও এইসব ফেসবুক মুফতি (?) শুধু মাসআলায় ভিন্নমত দিলেই আহলে ইলম ও আমল লোকদেরও নানা ট্যাগ দেয়।

আমি কিছু কুলাঙ্গার সাংবাদিকের মসজিদ উস্কানির প্রতিবাদ করতে বারণ করছি না। তাদের প্রতিবাদে তো আমাদের এতটুকু বললেই হত : (তর্কের খাতিরে বলছি) আগে গার্মেন্ট বন্ধের কথা বলেন। কিন্তু তা না করে মাসআলা লক করি কিভাবে? আমাদের পরিস্থিতি ততটা খারাপ হলে, তখন আমরা এ মাসাআলা বলব। ইখতিলাফি মাসআলায় তো স্পেস রাখাই ফিকহের নীতি। ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা দেখিয়েই নিজের মত দিতে হয়। ‘বিচার মানি তাল গাছ আমার’ তো ফতোয়ায় চলে না।

মুমিন এক গর্তে দুইবার পড়ে না। এক ভুল দুইবার করা ঈমানদারের কাছে কাম্য নয়। একবার তো সিদ্ধান্ত বদলাতে হলোই। কয়েকদিন পর যদি প্রয়োজনে আগের ফতোয়াও বদলাতে হয় তখন? দূরদর্শিতা তো থাকতে হবে! মালয়েশিয়ায় ইজতেমায় একসাথে ১৪২ জন, কোরিয়ায় গির্জা থেকে, সবশেষ মিরপুরে একজন প্রাজ্ঞ ইসলামিক স্কলার শিকার (সম্ভাব্য) মসজিদ থেকেই। তারপরও চোখ বুজে বলেই যাবেন একইকথা? পৃথিবীর আর কোথাও তাকওয়া আর ফিকহসম্পন্ন আলেম নেই? তারা কী বলছেন দেখবেন না? পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে পরিমাপ করবেন না? ‘মান লাফ ইয়ারিফ আহলা যামানিহি, ফাহুয়া জাহিলুন’ নীতি কোথায় যাবে?

একান্ত বাধ্য না হলে মসজিদ বন্ধ করা উচিত নয়, কাম্য নয়- এসব বলেন। জামাত স্থগিত রাখা যাবেই না- বলেন কীভাবে? মুত্তাফাকুন আলাইহি হাদিসগুলো কোথায় যাবে? ‘হালত’, ‘জরুরত’ মূলনীতি কখন প্রযোজ্য হবে? (আল্লাহ না করুন) আপনার মসজিদে মুয়াজ্জিন বা খাদেম আক্রান্ত হবার খবর পেলে আপনাকে পাওয়া যাবে? আপনার পরিবারের সদস্য আক্রান্ত হওয়ার খবর পেলে আপনি জুমার ভিড়ে নির্ভয়ে থাকবেন তো?

আপনি খণ্ডিতভাবে হাদিস ‘সংক্রমণ নেই’ বলেই যাবেন, পরের অংশ ‘কুষ্ঠ রোগী দেখে পালাও’ দেখবেন না? আপনি আসবাব (সামগ্রী) অস্বীকার করে তাওয়াক্কুলের কথা বলেই যাবেন, উমর (রা.) এর মহামারি এলাকা থেকে ফিরে যাওয়া এবং প্রিয় আবু উবায়দাকে (রা.) বাঁচানোর জন্য মদিনায় চলে আসার আহ্বান বিবেচনা করবেন না? কুষ্ঠ রোগী দেখে সাকিফ গোত্রের সাহাবির সঙ্গে নবীজির (সা.) হাত না মেলানো দেখবেন না? আপনি বিশ্বজুড়ে সব চিকিৎসকের হাতে প্রমাণিত করোনা-সংক্রমণ অস্বীকার করে নিজের ‘আকল’ শুধু নয়, ইসলামকেও বিতর্কিত করছেন না?

আল্লাহ যাদের সম্পর্কে বারবার বলেছেন ‘তাদের অধিকাংশই জানে না, বোঝে না’ তাদের খুশি করার জন্য সস্তা কথা বলবেন না। আপনি তো পড়েছেন ফতোয়া যেন ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বাক্ষর’। অতএব সবদিক ভেবে কথা বলুন। আবেগে, জোশে কথা বলবেন না। আপনার অবিবেচক বক্তব্যের মাশুল কোনো নিরীহ মুসলিম বা ইসলাম দিতে পারে না। আল্লাহ আমাদের সহিহ বুঝ দান করুন।

হাযা মা কুলতু। ইন আসাবতু ফা মিনাল্লাহ। ওয়া ইন আখতা’তু ফা মিন নাফসি ওয়াশ-শাইতান। ওয়াল্লাহু আ’লামু বিস-সাওয়াব।

আলী হাসান তৈয়ব

সহকারী সম্পাদক আলোকিত বাংলাদেশ