‘আমার মেয়ের ওপর অনেকগুলো অশুভ আত্মা ভর করেছে’

দেশসেবা দেশসেবা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ৫:২৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৬, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিনিধি।‘আমার মেয়ের ওপর অনেকগুলো অশুভ আত্মা ভর করেছে’—এক ভদ্রমহিলা ফিসফিস করে আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললেন। আমি ‘কী’ বলে সরু চোখে তাকিয়ে ভদ্রমহিলাকে মাপতে চাইলাম।

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘জ্বী, এই জন্যই মেয়েকে আগে রুমে ঢুকাই নাই। আগে আপনাকে বলে নেই, আমার মেয়ের ভেতরে অনেকগুলো আত্মা থাকে। কী যে কান্ডটা করে বাড়িতে। একটা পুরুষ আর একটা মহিলা ছিল আগে থেকেই। ইদানীং এর সঙ্গে যোগ হইছে একটা বাচ্চা।’

ভদ্রমহিলা আরও বললেন, ‘তাবিজ, কবজ, মন্ত্র, পানি পড়া, হুজুর, তান্ত্রিক—কিছুই বাদ দেই নাই। কিন্তু দিনে দিনে ওদের জোর আরো বাড়ছে। তার মধ্যে পুরুষটা মোটা গলা দিয়ে খুব চিল্লাচিল্লি করে। মহিলাটা যখন ভর করে তখন মেয়েটা আমার খালি কাঁদে। আর বাচ্চাটার আত্মা যখন ভর করে, তখন অসম্ভব ভয়ে কাঁপতে থাকে। খাটের তলে ঢুকে যায়। মাথার মধ্যে চাদর মুড়ি দিয়ে বিছানায় বসে থাকে। তখন থরথর করে কাঁপে, আর সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে যায়। মাঝে মাঝে মেয়ে আমার ভয়ে পেশাব পর্যন্ত করে ফেলে। একেকটা আত্মা যখন আসে, তখন সে একেক রকম আচরণ করে। কাপড় পরার ধরণও পাল্টে যায়। এমন কি মাথার সিঁথি পর্যন্ত বদলে ফেলে। এসব দেখলে আমার বুকটা ভেঙে যায়।’

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। মানুষের অসহায়ত্ব দেখলে কষ্ট লাগে। নিজেকে ছোট মনে হয়। মনে হয়, তার কষ্টের পোঁটলাটা দুমড়ে–মুচড়ে আমার মুখের উপর ছুঁড়ে মারছে। আমি কিছুই করতে পারি না। ভদ্রমহিলাকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলাম। তিনি ঢক ঢক করে পুরো গ্লাসটা একবারে খালি করে দিলেন। টিস্যুর বাক্সটি এগিয়ে দিলাম, তিনি মুখ মুছলেন। বুঝলাম ধাতস্থ হলেন।

মৃদু গলায় জানতে চাইলাম, ‘ওর ছোটবেলাটা কেমন ছিল?’ ভদ্রমহিলা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলেন। পেশাগত কারণে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আমার সহজাত অভিজ্ঞতা। ভদ্রমহিলা বারকয়েক চোরা চোখে আমার দিকে তাকাতে প্রতিবারই চোখাচোখি হয়ে গেল। কেমন যেন একটি চোরা চোরা ভঙ্গি।

‘আপনার মেয়ের যদি ছোটবেলার কোন ঘটনা থাকে, তা আমাকে জানানো ভালো নয় কি?’—আমার এই কথা শোনার পর ভদ্রমহিলা একটু থমকালেন। সম্ভবত মাপার চেষ্টা করলেন, আমাকে কতটুকু বিশ্বাস করা যায়।

এরপর ভদ্রমহিলা শুরু করলেন তাঁর কথা। মেয়েটি আর তার ছোটো ভাই পিঠাপিঠি। ফলে ভাই হওয়ার পর বাবা–মা নতুন বাচ্চাটিকে নিয়ে এক ঘরে থাকতেন। ছোট রুম, তাই মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিলেন পাশের ঘরে দাদির কাছে।

ইতোমধ্যেই মেয়েটির বয়স যখন তিন বছর, তখন ওই বাসার ড্রয়িংরুমে থাকতে আসলেন মেয়েটির মামা। কারণ সেই মামা কেবলমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে শুরু করেছেন। হলে সিট পাননি, তাই তাদের বাসায় থাকছেন। ঠিক এখান থেকেই শুরু হলো তিন বছরের শিশুটির বিভীষিকাময় জীবন।

পরবর্তীতে মেয়েটির সঙ্গে একাধিকবার সেশন হয়। সেখান থেকে উঠে আসে বীভৎস কিছু তথ্য। বাচ্চাটিকে বাথরুম করাতে সাহায্য করার নামে দিনের পর দিন চলেছে ভয়ংকর যৌন নির্যাতন। নির্যাতনকারী স্বয়ং ওই তথাকথিত নিরাপদ মামা। এদিকে মা–বাবা কিন্তু ভীষণ খুশি। কারণ মামা থাকায় বাড়তি একটি সাহায্যের হাত তারা পেলেন। দাদিও খুশি।

কারণ তিন বছরের বাচ্চার প্রস্রাব, পায়খানা ঘাটতে হচ্ছে না। মামা বাচ্চাকে লিপস্টিক এনে দিতেন। বাবা–মা মনে করতেন উপহার। কিন্তু আসলে সেটা ছিল শিশুকে তরুণী করার একটি রঙিন স্থূল প্রচেষ্টা। পরবর্তীতে শৈশব পেরুলে বালিকাবেলায় মামা বিভিন্ন রঙের অন্তর্বাস এনে দিত। সেটাও বালিকাকে তরুণী করার আরেকটি অপচেষ্টা। আমি কল্পনা করতে গিয়ে শিউরে উঠি, এমন কত হাজার মামা আমাদের সমাজে ভালো মানুষের মুখোশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন!

কাজেই মেয়েটার অবচেতন মনের গভীরে ঘাপটি মেরে বসে থাকল তারুণ্য সম্পর্কে কিছু অবাস্তব, বিকৃত ধারণা। ধীরে ধীরে মেয়েটি বড় হতে থাকল। এর সঙ্গে তীব্র ভয়, অব্যক্ত বেদনাবোধ, সঙ্গে শারীরিক প্রচণ্ড ব্যথা বাচ্চাটিকে দিশেহারা করে তুলল। এই বাচ্চাটি প্রায়ই প্রস্রাবের ইনফেকশনে ভুগত, জ্বরও থাকত, তলপেটে তীব্র ব্যথাও করত। ফলে আস্তে আস্তে বাচ্চাটির অবচেতন মন তৈরি করল কতগুলো ব্যক্তিত্ব। যাদের আবাস হলো ঠিক তার মাথার ভেতর। এটাই ছিল তার নিজেকে এইসব ভয়, দুঃখ, বেদনা, রাগ থেকে বিচ্ছিন্ন করবার শৈশবের একটি প্রয়াস। কারণ শিশুমন আর এই যন্ত্রণাগুলো নিতে পারছিল না। তাই নিজের মাথার ভেতরে সে অন্য কতগুলো ব্যক্তিত্ব বা আত্মসত্তা তৈরি করল। যেটা তার নিজের ভয়, বেদনা, রাগকে সামাল দেওয়ার একটা পদ্ধতি হয়ে গেল। যেটাকে মনস্তাত্ত্বিক ভাষায় আমরা কোপিং মেকানিজম বলি।

আর ঠিক এখান থেকেই বাচ্চাটির অবচেতন মনে জন্ম নিতে থাকল একাধিক ব্যক্তিত্বের। কখনো কখনো মানুষের মধ্যে একাধিক সত্তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। একে আমরা মানসিক ডিজঅর্ডার বলছি। ইংরেজিতে বলা যায়, Dissociative Identity Disorder (DID)। একই মনের ঘরে একাধিক ব্যক্তিসত্তার বা অস্তিত্বের সংকট। সহজ বাংলায়—একজনের মনে বহুজনের বাস!

আলোচ্য মেয়েটি এটাতেই ভুগছে। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে আসার আগেই, মা তেল পড়া, পানি পড়া, কবিরাজ, হুজুর, তান্ত্রিক, তাবিজ, কবজ, আয়না পড়া, ওঝা কাউকে বাদ রাখেন নি। ফলে উপকার তো হয়নি বরং অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি তার চিন্তা, স্মৃতি, পারিপার্শ্বিক কাজ এবং সত্তার মধ্যে যোগসূত্রটি হারিয়ে ফেলে। এই হারিয়ে ফেলাটি হয় অবচেতনভাবে হয়। তারা বাস্তব জগৎ থেকে এমনভাবে সরে যান, যাতে তাদের প্রাত্যহিক জীবন ব্যাহত হয়। এটা যে আঘাতের কারণে হয়, সেই আঘাতজনিত তীব্র বেদনা স্মৃতিগুলোকে অবচেতনভাবেই আলাদা করে ফেলে।

এই আলাদা করার এক মেরুতে থাকে স্মৃতিভ্রষ্টতা বা অ্যামনেসিয়া। আর অপর মেরুতে থাকে অল্টারনেটিভ আইডেন্টিটি। পুরোটাই নির্ভর করে কোন ধরনের ডিশোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডার হচ্ছে তার ওপর। বিশেষ করে স্ট্রেস মুহূর্ত লক্ষণগুলোকে আরো খারাপ করে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় চিকিৎসা, সাইকোথেরাপি ও প্রয়োজন বুঝে ওষুধ। মূল কথা মানুষটিকে শিখতে হবে নতুন কোপিং স্ট্রাটেজি, যার ফলে তিনি কর্মক্ষম জীবন কাটাতে পারেন।

লেখক: চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাক্টিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার, বাংলাদেশ

(সূত্র:INDEPENDENT)