ডিসি ও ইউএনও ঋতুপর্ণা চাকমার বাড়ি ও সড়ক নির্মাণে সম্মতি, তবে আঞ্চলিক দলের বাধা

দেশসেবা দেশসেবা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ৩:১০ অপরাহ্ণ, মার্চ ২২, ২০২৫

মোঃ সোহেল।।

রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের দুর্গম মঘাইছড়ি গ্রামের কৃতি সন্তান ঋতুপর্ণা চাকমা, বাংলাদেশের জাতীয় নারী ফুটবল দলের এক উজ্জ্বল নাম। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের বিজয়ের অন্যতম নায়িকা এই তরুণী ২০২২ সালে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন একটি বাড়ি এবং গ্রামের মানুষের জন্য একটি যাতায়াত সড়ক। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রশাসন সদয় সম্মতি দিলেও সম্প্রতি একটি মহল তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ২০২২ সালে যখন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল প্রথমবার সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়, তখন রাঙামাটি জেলার পাঁচজন ফুটবলার জাতীয় দলে ছিলেন, যার মধ্যে দুইজন ছিলেন রাঙামাটি জেলার—ঋতুপর্ণা চাকমা ও রূপনা চাকমা। রূপনা চাকমার জন্য প্রশাসন দ্রুততার সঙ্গে একটি বাড়ি নির্মাণ করে দিলেও ঋতুপর্ণা চাকমার অনুরোধ ছিল ভিন্ন। তিনি নিজের জন্য কিছু চাননি; চেয়েছিলেন তার গ্রামের মানুষের সুবিধার্থে একটি রাস্তা, যাতে তারা নিরাপদে চলাফেরা করতে পারেন। সে সময় প্রশাসন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ঋতুপর্ণার জন্য একটি বাড়ি নির্মাণ করবে এবং গ্রামের মানুষের জন্য রাস্তা তৈরি করবে। কিন্তু বছর গড়ালেও সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। ২০২৪ সালে যখন বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়ন হয় এবং ঋতুপর্ণা সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন, তখন আবারো রাঙামাটি জেলা প্রশাসন তাকে সংবর্ধিত করে। এবার প্রশাসন প্রতিশ্রুতি পূরণের দিকে এগোয় এবং জেলা পরিষদ রাস্তা নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়। এমনকি ইউএনও কাজী আতিকুর রহমান নিজ উদ্যোগে তার বাড়িতে সুপেয় পানির জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন করেন। সবকিছু ঠিক থাকলেও, যখন বাড়ি নির্মাণ ও রাস্তা তৈরির কাজ শুরুর কথা, তখনই একটি অদৃশ্য মহল বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, মঘাইছড়ির বেশিরভাগ এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সন্তু গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন। কিছু অংশ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রসিত গ্রুপের দখলে। অভিযোগ উঠেছে, এই আঞ্চলিক দলগুলোর একটি অংশ ঋতুপর্ণার বাড়ি এবং যাতায়াত সড়ক নির্মাণে বাধা দিচ্ছে। পাহাড়ের পরিস্থিতি বরাবরই জটিল। আঞ্চলিক সন্ত্রাসী দলগুলো সাধারণত সরকারি উন্নয়নকাজে বাধা দেয়, কারণ উন্নয়ন হলে তাদের অবৈধ কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। সড়ক তৈরি হলে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত সেখানে পৌঁছাতে পারবে, ফলে তাদের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে। আরেকটি সূত্র বলছে, আঞ্চলিক দলগুলো উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ থেকে চাঁদা দাবি করে। কিন্তু ঋতুপর্ণার এলাকার সড়ক নির্মাণের বরাদ্দ সীমিত হওয়ায় চাঁদার পরিমাণ সেভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তাই হয়তো তারা গ্রামের কিছু জায়গার মালিকদের ব্যবহার করে এই বাধা সৃষ্টি করছে। এই পরিস্থিতিতে ঋতুপর্ণা চাকমা ২২ মার্চ নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে হতাশা প্রকাশ করে লেখেন: “২০২২ সালে প্রথমবারের মতো যখন সাফ চ্যাম্পিয়ন হই। তখন পাবর্ত্য চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচ সদস্য ছিলাম। আমি আর রুপনা চাকমা রাঙামাটি জেলার আর বাকি তিনজন খাগড়াছড়ি। রাঙামাটি জেলা আমাদের পাঁচজনকে রাজকীয়ভাবে সংবর্ধনা এবং সম্মানিত করেন। সেসময় স্বয়ং জেলা প্রশাসক আমার নিজ গ্রামের বাড়িতে এসেছেন আমার ঘরবাড়ি ও যাতায়াতের অবস্থান দেখে যান। সেবারে রুপনা চাকমাকে বাড়ি নিমার্ন করে দেন জেলা প্রশাসন। যা যা প্রতিস্রুতি দিয়েছেন সব-ই বাস্তবায়ন করে দেন। আমাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো আমার কি চাওয়া পাওয়া আছে প্রশাসন থেকে, তখন আমি চেয়েছিলাম আমার এলাকাবাসী সুবিধার্তে যাতায়াতের জন্য রাস্তা, কারণ আমার বাড়ির যাওয়ার রাস্তা নেই।আমি আমার নিজের জন্য কিচ্ছু চাইনি।রাঙামাটি জেলা প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছিলেন রাস্তা সংস্কার করে দিবেন, এবং সেই সাথে আমাকে জায়গাসহ বাড়ি করে দেওয়ার প্রতিস্রুতি দিয়েছেন। স্বয়ং আমাকে ডেকে নিয়ে ঘাগড়া বাজারে খাস জায়গা নির্ধারণ করেছেন এবং জায়গাটা আমারও পছন্দ হয়, সবকিছু ঠিকটাক হয় । যাইহোক রুপনার সবকিছু বাস্তবায়ন হয়েছে, আমার মনেও বিশ্বাস, আশা ছিল প্রশাসনের কাছ থেকে আমারও সবকিছু বাস্তবায়ন হবে। দুঃখের বিষয় আমার কোনকিছু বাস্তবায়ন হয়নি। যাইহোক ঔ বিষয় নিয়ে আমি আর মাথাঘামাইনি, অনুশোচনাও হয়নি । ২০২২গেলো সবকিছু ভুলে গেলাম আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে মনোযোগী হই। ২০২৪ দ্বিতীয়বারে মতো বাংলাদেশ সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়।সেই টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় পুরস্কার জিতেছি। দ্বিতীয়বারের মতো দেশবাসী সবাই মিলে আনন্দ, উল্লাস ভাগাভাগি করে উদযাপন করি। এক-ই ভাবে ২০২২সালে যেভাবে আমাদের সংবর্ধনা দিয়েছিলেন, ঠিক দ্বিগুণ সেভাবে-ই আমাদের রাজকীয়ভাবে সংবর্ধনা এবং সম্মানিত প্রদান করেন রাঙামাটি জেলা প্রশাসন। ২০২২সালে যে আমাকে মিথ্যা আশ্বাস এবং প্রতিস্রুতি দিয়েছেন, এই নতুন বাংলাদেশ, এই নতুন প্রশাসনের কাছ থেকে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বিগত ২০২২সালে জায়গাসহ বাড়ির করে দেওয়া এবং যাতায়াতের জন্য রাস্তা সংস্কার করে দেওয়ার প্রতিস্রুতি দিয়েছিলেন সেই-টা বাস্তবায়ন হবে। দেরিতে হলেও কিছুদিন আগে আমাকে UNO মহোদয় কাজী আতিকুর রহমান স্যার খুশির সংবাদটি জানিয়ে দেন, আমার এলাকার গ্রামবাসীর জন্য রাস্তা নির্মাণ বাবদ রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ হতে ইতোমধ্যে বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। একমাস আগে জেলা পরিষদের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদ সদস্য রাস্তাটি পরিদর্শনও করেছেন। UNO স্যারের উনার নিজ উদ্যোগে আমার বাড়িতে সুপেয় পানির জন্য নিজেই গভীর নলকূপ স্থাপন করে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক মহোদয় আমাকে একটা ঘর নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন। প্রশাসন রাস্তা এবং জায়গাসহ বাড়ির করে দেওয়ার অনুমোদন সম্মতি দিয়েছেন। আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি প্রশাসনকে , খুব-ই এক্সাইটেড ছিলাম সংবাদটা শুনে। এতোদিন পর প্রশাসন আমাকে বাড়ি করে দেওয়ার সদয় সম্মতি দিয়েছেন, কিন্তু এর মধ্যে আমি শুনতে পাচ্ছি কোনো এক মহল থেকে বাধা আসতে শুরু করেছে তাহলে কি আমার ঘাগড়ায় কি কোন ঠাঁই নেই?? এখন আমার অনুশোচনা হচ্ছে, ২০১৭ সাল থেকে আমি দেশের জন্য খেলতেছি দেশের প্রতিনিধিত্ব করতেছি,নিজে জেলার মানুষের কাছে মূল্যায়নটা পাইলাম কই?? লিখাই যদি ভুলক্রটি থাকে ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন ধন্যবাদ।” ঋতুপর্ণা চাকমা শুধু নিজের জন্য নয়, তার গ্রামের মানুষের জন্যও উন্নয়ন চেয়েছিলেন। প্রশাসন দীর্ঘদিন পর সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে চাইলে, অদৃশ্য শক্তিগুলো বাধা সৃষ্টি করছে। এটি শুধু ঋতুপর্ণার সমস্যা নয়, বরং এটি পাহাড়ের একটি চিরাচরিত সংকট। উন্নয়নকে থামিয়ে রাখার এই অপচেষ্টা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। সরকার ও প্রশাসনের উচিত এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উন্নয়ন নিশ্চিত করা, যাতে পাহাড়ি জনগণও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো মৌলিক সুবিধাগুলো পায়। ঋতুপর্ণা চাকমার প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? দেশের প্রতিনিধিত্ব করা এক খেলোয়াড়ের নিজের জন্মভূমিতে যদি ঠাঁই না থাকে, তাহলে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ কিভাবে ন্যায়বিচার পাবে?